রবীন্দ্রনাথ বাঙালির অনুপ্রেরণা ও নতুন আশার বাণী-গোপাল অধিকারী

0
459
গোপাল অধিকারী

রবীন্দ্রনাথ বাঙালির অনুপ্রেরণা ও নতুন আশার বাণী-গোপাল অধিকারী: ২৫ বৈশাখ, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম। ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ (৭ মে, ১৮৬১) কলকাতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে রবীন্দ্রনাথের জন্ম ধনী এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারে। মা সারদাসুন্দরী দেবী এবং বাবা বিখ্যাত জমিদার ও ব্রাহ্ম ধর্মগুরু দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

পৃথিবীটা কঠির সমরক্ষেত্র। এই সমরক্ষেত্রে মানুষ মাত্রই জন্ম পরবর্তী সত্যই মৃত্যু। আর এই জন্ম ও মৃত্যুর মাঝামাঝি যা রয়েছে তা হলো কর্ম। কর্মগুণেই অস্তিত্ব মেলে ধরণীকূলে। কর্মগুণে তেমনই ধরণীকূলে আজও অমরণীয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র তিনি। সাহিত্যাঙ্গনের এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে তার স্পষ্ট পদচারণা পড়েনি। সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে তার দুই হাত ভরে উজাড় করা দানে। রবীন্দ্রনাথের এই অমর সৃষ্টি বিশ্বের দরবারে স্থান পেয়েছে অনন্য মর্যাদায়। আজকের যুগে যেখানে একজন ভাল কবি পাওয়া দুষ্কর সেখানে রবীন্দ্রনাথ একাধারে অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোট গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক।

৮ বছর বয়সে কবিতা লেখা শুরু করেন গুণী এই কবি। ১৮৭৫ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাতৃবিয়োগ ঘটে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ দেশ ভ্রমণের নেশায় বছরের অধিকাংশ সময় কলকাতার বাইরে অতিবাহিত করতেন। তাই ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হয়েও রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা কেটেছিল ভৃত্যদের অনুশাসনে। শৈশবে তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নরম্যাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে পড়াশোনা করেন। ছেলেবেলায় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে অথবা বোলপুর ও পানিহাটির বাগানবাড়িতে প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন।

১৮৭৮ সালে ব্যারিস্টারি পড়ার উদ্দেশে তিনি ইংল্যান্ড যান। সেখানে তিনি ব্রাইটনের একটি পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ১৮৭৯ সালে ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে আইনবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। প্রায় দেড় বছর ইংল্যান্ডে কাটিয়ে ১৮৮০ সালে কোনো ডিগ্রি না নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। ১৮৮৩ সালের ভবতারিণীর সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

বিবাহিত জীবনে ভবতারিণীর নামকরণ হয়েছিল মৃণালিনী দেবী। এর মধ্যেই চলতে থাকে তার সাহিত্যচর্চা। ১৮৯১ সাল থেকে পিতার আদেশে নদিয়া, পাবনা, রাজশাহী ও উড়িষ্যার জমিদারি তদারকি শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ। কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে তিনি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ সপরিবারে শিলাইদহ ছেড়ে চলে আসেন বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের উপকণ্ঠে শান্তি নিকেতনে।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক কিছুরই প্রথম রূপকার তিনি। তার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যে নতুন যুগের সৃষ্টি হয়। বাংলা গদ্যের আধুনিকায়নের পথিকৃৎ রবিঠাকুর ছোটগল্পেরও জনক। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, নতুন নতুন সুর ও বিচিত্র গানের বাণী, দার্শনিক চিন্তাসমৃদ্ধ প্রবন্ধ, এমনকি চিত্রকলায়ও রবীন্দ্রনাথ চিরনবীন, চিরঅমর। রবীন্দ্রনাথ আজও আমাদের মনমানসিকতা গঠনের, চেতনার উন্মেষের প্রধান অবলম্বন। আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি ‘বাংলাদেশ’ নামের বানানটিও আমরা তার কাছ থেকে পেয়েছি। বাঙালির যাপিত জীবনাচরণের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গান অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্বের দরবারে বিশেষ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন।

‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি প্রথম এশীয় হিসেবে ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু ২০০৪ সালে রহস্যজনকভাবে ‘নোবেল পদক’সহ চুরি যায় কবির ব্যবহার্য অন্তত অর্ধশত মূল্যবান জিনিস।এ ব্যাপারে ভারতের প্রায় সব গোয়েন্দা সংস্থার চেষ্টায়ও চুরির সুরাহা করতে পারেনি। চুরির দিন ২৫ মার্চ ২০০৪ বুধবার ছিল শান্তি নিকেতনের ছুটি। বৃহস্পতিবার রবীন্দ্র ভবন খুলতেই ধরা পড়ে চুরির ঘটনা। কিন্তু কীভাবে চুরি হয় তা নিশ্চিত নয় পুলিশ।

মঙ্গলবার বিশ্বভারতী বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগেই চোরেরা ভিতরে ঢুকে অবস্থান নেয়। সারা রাত ধরে মালপত্র সরাতে থাকে। রবীন্দ্র ভবনের পেছনের জানালা ভেঙে ফেলে চোর, দেয়ালের নিচে পাওয়া যায় ভাঙা গ্রিল। ধারণা করা হয়, সেই জানালা দিয়ে চোর মালপত্র সরিয়ে নেয়। দেশজ শিক্ষা ব্যবস্থা বিকাশের লক্ষ্যে গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি একজন সমাজসংস্কারকও ছিলেন। গ্রামীণ সমাজের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে কৃষির উন্নয়নে নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। বাংলায় আলু, ভুট্টা ইত্যাদি চাষের সূচনা ঘটে তারই উদ্যোগে। দরিদ্র কৃষককে ঋণ দেয়ার লক্ষ্যে নোবেল পুরস্কারের অর্থে কৃষি ব্যাংকের কাজ শুরু করেন তিনি। বঙ্গভঙ্গ রদ করার দাবিতে তিনি হিন্দু-মুসলমানদের নিয়ে রাখিবন্ধন কর্মসূচিতে রাজপথে নেমে আসেন।

১৯১৫ সালে ব্রিটিশ সরকার তাকে ‘নাইট’ উপাধি দিলেও ১৯১৯ সালে পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগে ব্রিটিশ বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

জীবনের শেষ দিনগুলোয় একাধিক অসুখ ভর করেছিল কবিগুরুকে। নানা রকম ওষুধেও কাজ হচ্ছিল না। সে সময় তিনি শান্তিনিকেতনে ছিলেন। রোগ উপশমে চিকিৎসকরা অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কবিগুরুর তাতে মোটেও মত ছিল না। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষকে তো মরতেই হবে এক দিন। একভাবে না একভাবে এই শরীরের শেষ হতে হবে তো, তা এমনি করেই হোক না শেষ। মিথ্যে এটাকে কাটাকুটি ছেঁড়াছেঁড়ি করার কী প্রয়োজন?’ কিন্তু তিনি যে অসহনীয় যন্ত্রণায় কষ্ট পাচ্ছেন। তার উপশমের জন্য দেহে অস্ত্রোপচার করতেই হবে বলে মত ছিল চিকিৎসকদের। সব শেষে কবিকে রাজি করিয়ে আনা হয় কলকাতায়। আর সেটাই ছিল রবীন্দ্রনাথের শেষবারের মতো শান্তিনিকেতন ছেড়ে আসা।

১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আনা হয় জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। হাঁটার মতো অবস্থা না থাকায় স্ট্রেচারে করে তাকে দোতলায় নিতে হয়েছিল। সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আপন লোক পেয়ে বেশ প্রফুল্ল ছিলেন। ৭ আগস্ট ছিল ২২ শ্রাবণ। কবিকে সকাল ৯টার দিকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে ক্ষীণ হতে থাকে। দুপুর ১২টার দিকে একেবারে থেমে গেল। সেদিন জনারণ্যে পরিণত হয়েছিল ঠাকুরবাড়ি। শোকের মিছিলে জমায়েত হয়েছিল সবাই।

জীবনে বাঁচতে হলে ্জ্ঞান, বুদ্ধি, ধৈর্য ও সাহস উভয়ই প্রয়োজন। প্রয়োজন মানবতা, আনতরিকতা প্রেরণা ও আত্মবিশ্বাস। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে করোনার মতো মহামারী যেখানে বিশ্বকে গ্রাস করেছে সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মানবতার বাণী মানুষকে সাহসী, ধৈর্যশীল করে এগিয়ে যেতে পথ দেখাতে পারে। নশ্বর শরীরের বিদায় হলেও কবিগুরু তার কর্মে আমাদের মাঝে বর্তমান আছেন, থাকবেন। তার সৃষ্টি বাঙালির নিত্যদিনের জীবনচর্চায় মিশে আছে গভীরভাবে। কবির ভাষায় বলা যায়, ‘জীবনে মৃত্যু করিয়া বহন প্রাণ পাই যেন মরণে।’

তিনি আরও লিখে গেছেন, ‘মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই। এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে/জীবন হৃদয় মাঝে যদি স্থান পাই।’সেদিন শরীরের বিদায় হলেও আনন্দে, বেদনায়, দ্রোহে এখনো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালির প্রেরণার প্রধানতম উৎস।

রবীন্দ্রনাথের ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাটক, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। তার সর্বমোট ৯৫টি ছোটগল্প ও ১৯১৫টি গান যথাক্রমে গল্পগুচ্ছ ও গীতবিতান সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তার যাবতীয় রচনা ৩২ খন্ডে রবীন্দ্র রচনাবলিতে আছে। যা আজও রব্ন্দ্রীবাণী ছড়াচ্ছে। আজও প্রেরণা যোগাচ্ছে প্রেরণাহীনদের, সাহস যোগাচ্ছে ভীরুদের।

রবীন্দ্রনাথের সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনাই তাকে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা হিসেবে উপস্থাপন করে; তার জীবন দর্শন, মূল্যবোধ ও মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ আর কোনো বাঙালির জীবনে ঘটবে বলে মনে হয় না। আজো রবীন্দ্রনাথ আমাদোর জীবনে সমানভাবে প্রাসঙ্গিক; এই কথা সহজেই অনুমেয় এবং বিবেচ্য কারণ তাঁকে বাদ নিয়ে কেউ সম্পূর্ণ রূপে বাঙালি হয়ে উঠতে পারে না।

আমাদের প্রকৃত বাঙালি হয়ে উঠতে গেলে ক্রমশ রবীন্দ্রনাথকে গ্রহণ করতে হবে; কোথায় নেই তিনি বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে রবীন্দ্রনাথের জাদুকরি হাতের স্পর্শ পড়েনি শুধুমাত্র মহাকাব্য ছাড়া। জন্ম থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে জন্ম, বিরহ থেকে আনন্দ, বিষাদ থেকে আত্মপ্রকাশ সব কিছুর ভেতরেই আমাদের শ্রেষ্ঠতম আশ্রয় হলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ জীবনে বহুবার বৃহৎ বিশ্বের পথে পা বাড়িয়েছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত স্বমিÍ লাভ করেছেন বাংলার মাটিতে পা রেখে, তাই তো বলেছিলেন মোর নাম- এই বলে খ্যাত হোক/ আমি তোমাদেরই লোক/ আর কিছু নয়/ এই হোক শেষ পরিচয়!

রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত বিরাট প্রেরণা হয়ে ছিল। বিশ্বে খুব কম কবিই এরকমভাবে কোনো দেশের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন। বাংলা, বাঙালি আর রবীন্দ্রনাথ এক সুতোয় গাঁথা।

জগতে যারাই কর্মকে প্রাধান্য দিয়েছে তারাই অমর হয়েছে। তারা মরেও কীর্তিমান। তাদের ,মরণ নেই। দেড়শ’ বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও বাঙালি মানসে রবি ঠাকুর এখনো তিনি দিবাকরের মতো সমান সমুজ্জ্বল, তাঁর কিরণ আজো চির অম্লান। আজও রবীন্দ্রনাথ বাঙালির অনুপ্রেরণা ও নতুন আশার বাণী। ##

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here