যত দূর এগোল শিক্ষাব্যবস্থা

0
88
শিক্ষাব্যবস্থা

যত দূর এগোল শিক্ষাব্যবস্থা। গত একান্ন বছরে শিক্ষায় আমাদের অর্জন সামান্য নয়। আমরা যদি এই অর্জনের একটা হিসাব নিতে বসি, দেখা যাবে, এর পেছনে সবচেয়ে সক্রিয় শক্তিটি ছিল সমাজ, যা শিক্ষাকে বিনিয়োগের একটা প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে সেই দেশবিভাগের পর থেকেই চিহ্নিত করেছে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র পরিবারটিও চায়, সন্তানেরা শিক্ষিত হোক, যদিও অভাব তীব্র হলে সন্তানদের কাজে লাগাতে বাধ্য হয়। অর্জনের পেছনের আরেকটি কারণ হচ্ছে মেয়েদের শিক্ষাকে অগ্রাধিকারের তালিকায় রাখা, যা আশপাশের অনেক দেশেই দেখা যায় না। সমাজের এই ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটেছে সরকারের উদ্যোগে, যদিও শিক্ষার জন্য বাজেট বরাদ্দ বৈশ্বিকভাবে স্বীকৃত জিডিপির ৬ শতাংশ থেকে অনেক কম।

অর্থনীতিতে উল্লম্ফন ঘটলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্দ এই একান্ন বছরে আমাদের জিডিপির ২ শতাংশের বেশি বাড়েনি। বড় বিনিয়োগ না হলে শিক্ষা ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন হবে না, এবং বড় পরিবর্তন না হলে ২০৪১ সাল, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব—এ সবকিছুর জন্য আমরা প্রস্তুত হতে পারব না।

আমাদের অর্জন অনেক বেশি হতে পারত, যদি বরাদ্দ শুরু থেকে অল্প অল্প করে বেড়ে দশ-পনেরো বছর আগে ৬ শতাংশে পৌঁছাতে পারত। তারপরও সরকারি উদ্যোগের নিরবচ্ছিন্ন প্রয়োগের কারণে শিক্ষার বিস্তার ঘটেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি প্রায় শতাংশ অর্জিত হয়েছে।

অর্জনের আরও কয়েকটি কারণ হচ্ছে: অর্থনৈতিক অগ্রগতি। এই অগ্রগতির একটি প্রতিফলন অবশ্য পড়েছে পুঁজির অধিষ্ঠানে, নানান ক্ষেত্রে বাজার সৃষ্টিতে, পণ্যায়নের একটা সার্বিক আবহ তৈরিতে এবং সামাজিক বৈষম্যের প্রকট আকার ধারণের ক্ষেত্রে। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়িয়েছে, যার ফলে সামাজিক গতিশীলতা বেড়েছে।

কৃষি উন্নয়ন। যার ফলে প্রান্তিক কৃষকও অনেক ক্ষেত্রে তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে উৎসাহী হয়েছে।

যোগাযোগের ক্ষেত্রে অগ্রগতি। এর ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি ও পর্যটন সেবা খাতসহ অনেক অঞ্চলেই ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সমাজ আরও গতিশীল হয়েছে, মানুষে মানুষে, অঞ্চলে অঞ্চলে দূরত্ব কমেছে। শিক্ষার সম্প্রসারণের জন্য এর প্রয়োজন ছিল।

এসবের সম্মিলিত প্রভাবে বাংলাদেশে শিক্ষা এগিয়েছে—যতটা না মানের দিক থেকে, তার চেয়ে বেশি পরিমাণ ও বিস্তারের দিক থেকে। এই বৃদ্ধির একটি বিস্তারিত পরিসংখ্যানচিত্র দেওয়া গেলে বিষয়টি পরিষ্কার হতো, কিন্তু স্থানাভাবে তা দেওয়া সম্ভব নয়। তারপরও বলা যায়, প্রাথমিক পর্যায় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এই বৃদ্ধি বা বিস্তার ১৯৭১ সালের বিজয়ের মাস থেকে এখন পর্যন্ত বিস্ময়কর। ১৯৭১ সালে সব ধরনের প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ছিল ২৭,১৩৪; এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪০,০০০-এর ধারেকাছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল মাত্র ৬; ২০২২ সালে সেই সংখ্যা ১৬০ বা এরও বেশি। শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সংখ্যাও বেড়েছে, তবে অনুপাতের হিসাবে অনেক বেশি। পাঠ্য বিষয়, শিক্ষাসূচি ও বিশেষায়িত পাঠক্রমের ক্ষেত্রেও বৃদ্ধির চিত্রটি ঊর্ধ্বমুখী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা, প্রকৌশল ও স্থাপত্য, কৃষি ও ব্যবসা-বাণিজ্য—সব ক্ষেত্রেই এখন শিক্ষার প্রচুর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

চামড়া প্রযুক্তি, সিরামিক, গ্রাফিক শিল্প অথবা টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রের মতো বিষয়েও এখন বাংলাদেশে উচ্চতর পর্যায়ে পাঠ দেওয়া হয়। তথ্যপ্রযুক্তি, বিশেষ করে কম্পিউটার, ইলেকট্রনিক ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নতিটা হয়েছে প্রকৃতই আশাব্যঞ্জক। সরকার সারা দেশের স্কুলগুলোকে তথ্যপ্রযুক্তিসক্ষম করতে, সেগুলোতে ইন্টারনেট সংযোগ ও সেবা দেওয়ার জন্য একটি উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

শিক্ষার্থীদের, বিশেষ করে মেয়েদের বৃত্তি ও উপবৃত্তি বাড়ানো হয়েছে, দশম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্যে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হচ্ছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণ আরও কার্যকর ও নিবিড় করা হচ্ছে।

উচ্চশিক্ষার চাহিদা অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যথেষ্ট না থাকায় ১৯৯০-এর দশক থেকে এই শূন্যস্থান পূরণের জন্য শুরু হয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, যার সংখ্যা এখন ১০০ ছাড়িয়েছে। এদের বেশির ভাগের শিক্ষাদান মানসম্পন্ন হলে উচ্চশিক্ষা অনেক বেশি কার্যকর হতো।

শিক্ষায় আমাদের অর্জন অনেক বেশি হতে পারত, যদি শিক্ষা তিন ধারায় ভাগ না হয়ে একই ধারায় দেওয়া হতো, ভাষা, গণিত, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে আমাদের দক্ষতা আরও বাড়ানো যেত, শিক্ষা বাজারমুখী, মুখস্থনির্ভর না হয়ে শুরু থেকেই সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনক্ষম হতো। টিউশন-বাণিজ্য আমাদের শিক্ষাকে ক্রমাগত অকার্যকর করে দিচ্ছে, যেমন দিচ্ছে নকলের প্রবণতা।

পাঠ্যক্রম, পাঠ্যবই, শিখন, শিক্ষাদানসহ শিক্ষাক্রমের সকল ক্ষেত্রে মানের উন্নতি ঘটাতে হবে; শ্রেণিকক্ষ, পাঠাগার, গবেষণাগারসহ সকল ভৌত কাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা পর্যাপ্ত করতে হবে। ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো শিক্ষা দেওয়া, ভালো শিক্ষার্থী তৈরি করা সম্ভব নয়। আর ভালো শিক্ষক পেতে হলে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা প্রচুর বাড়াতে হবে। যদি একদিন দেখা যায়, পেশার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ও গবেষণা এবং শিক্ষকতাকে এক নম্বরে রাখছেন, তাহলে বুঝতে হবে আমরা সত্যিকারভাবে উল্লম্ফনটা ঘটাতে পারছি।

শিক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও মতৈক্য থাকতে হবে।

আমরা যদি নয় মাস যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করতে পারি, তাহলে শিক্ষা ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে নয় বছরের বেশি সময় তো লাগার কথা নয়। এটি সম্ভব, যদি আমরা এই লক্ষ্যে একাত্তরের মতো ইচ্ছাশক্তি নিয়ে নামি।

লেখক
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here