ইলিশের অবাধ প্রজনন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে চলতি অক্টোবর মাসে ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর (বাংলা ২২ আশ্বিন থেকে ১৩ কার্তিক) মোট ২২ দিন দেশব্যাপী ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এ সময় ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করা হলে এক-দুই বছর মেয়াদে জেল কিংবা ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে।
ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছ। বাঙালির কৃষ্টি ও সংস্কৃতির সঙ্গে ইলিশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ইলিশ মাছের চর্বিতে প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। উক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের প্রায় শতকরা ২ ভাগ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, যা মানবদেহে কোলেস্টরেলের পরিমাণ হ্রাস করে হূদেরাগের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া ইলিশ মাছের আমিষে ৯ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা মানুষের পাকস্থলী তৈরি করতে পারে না। ইলিশের চর্বিতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন এ এবং ডি থাকে।
ইলিশ একটি অভিপ্রায়ণশীল মাছ। মূলত সাগরে বসবাস করে। প্রজনন ও ডিম ছাড়ার জন্য ইলিশ সাগর থেকে আমাদের নদ-নদী, মোহনা ও উপকূলীয় এলাকায় অভিপ্রায়ণ করে। বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, ইলিশ মাছ সারা বছরই কম-বেশি ডিম ছেড়ে থাকে; তবে এর প্রধান প্রজনন মৌসুম দুটি। একটি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি (পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে ফাল্গুন মাসের মাঝামাঝি), অন্যটি সেপ্টেম্বর-অক্টোবর (ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি থেকে কার্তিকের মাঝামাঝি) মাসে। এর মধ্যে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর প্রজনন মৌসুমে ইলিশ সবচেয়ে বেশি ডিম ছেড়ে থাকে। প্রধান প্রজনন মৌসুমে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারের সময় পরিপক্ব বা ডিমওয়ালা ও ডিম নির্গত অবস্থার ইলিশ মাছ সমুদ্র থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উজানে প্রবেশ করে।
ইলিশের ডিম ছাড়ার সময়কাল পূর্ণিমা ও অমাবস্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত। ইলিশ পূর্ণিমায় বেশি হারে ডিম ছাড়ে। দেখা গেছে, আশ্বিনের ভরা পূর্ণিমার আগে-পরে ইলিশ সবচেয়ে বেশি প্রজনন করে। এ সময় ইলিশের প্রাচুর্য্য সবচেয়ে বেশি থাকে এবং জেলেদের জালেও ধরা পড়ে বেশি। গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে ২০০৭-২০০৮ সালে দেশে প্রথম অক্টোবর মাসের ১৫-২৪ তারিখ ১০ দিন ইলিশের ভরা/সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সরকার কর্তৃক উক্ত সময়ে দেশে প্রথম ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। বর্তমানে তা সংশোধিত আকারে ২২ দিন করা হয়েছে।
উক্ত ২২ দিন সময়কালে একটি পূর্ণিমা ও একটি অমাবস্যা থাকায় সর্বোচ্চসংখ্যক ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে। বিএফআরআই পরিচালিত গবেষণা তথ্যমতে, গত ২০২১ সালে নিষিদ্ধকালীন ৫১ শতাংশ মা-ইলিশ সম্পূর্ণরূপে ডিম ছাড়তে সক্ষম হয়েছে। এতে প্রায় ৪২ হাজার কোটি জাটকা ইলিশ পরিবারে নতুন করে সংযুক্ত হয়েছে।
ইলিশের জীবনচক্র বৈচিত্র্যময়। এরা সাগরের লোনাপানিতে বসবাস করে; প্রজনন মৌসুমে ডিম দেওয়ার জন্য উজান বেয়ে মিঠাপানিতে চলে আসে। একটি ইলিশ ৩ থেকে ২৩ লাখ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেওয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে জাটকা হয় এবং ৫ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত পাঁচ-সাত মাস এরা নদীতে থাকে। পরে এরা আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ এক-দুই বছর বয়সে প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানির দিকে অভিপ্রয়াণ করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে।
ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল পাঁচ-সাত বছর। আহরিত ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট ৩ প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে দুটি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারা জীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর একটি মিঠাপানি ও লোনাপানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ স্রোতের বিপরীতে দৈনিক ৭১ কিলোমিটার অভিপ্রয়াণ করতে পারে।
পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে ইলিশের প্রায় ৮০ শতাংশ বাংলাদেশ আহরণ করে; বাকিটা মিয়ানমার, ভারতসহ অন্যান্য দেশ আহরণ করে। বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্যমতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখা নদী মহানন্দা ও তিস্তা এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মেদিও হাওরেও গত বছর ইলিশ পাওয়া গেছে।
ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা বর্তমান সরকারের একটি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম। এ লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় সরকার চলতি বছর দেশের ৩৭টি জেলার ১৫৫টি উপজেলার ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৫ কোটি ৫৫ হাজার জেলে পরিবারের জন্য পরিবারপ্রতি ২৫ কেজি হারে বিনা মূল্যে সর্বমোট প্রায় ১৪ হাজার মেট্রিকটন ভিজিএফ চাল মঞ্জুর করেছে। মত্স্যবান্ধব বর্তমান সরকারের এসব যুগোপযোগী ও প্রশংসিত কার্যক্রম বিগত কয়েক বছর যাবত্ মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন এবং মা ইলিশ ও জাটকা সুরক্ষার ফলে ২০২০-২১ অর্থবছরে ইলিশের উত্পাদন বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিকটনে উন্নীত হয়েছে, যার বাজারমূল্য (১ হাজার/কেজি হিসেবে) প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা।
ইলিশ উত্পাদনের এরূপ সফলতা জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পারছেন, জাটকা ও মা-ইলিশ সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিত হারে ইলিশ উত্পাদনের সুফল সরাসরি তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবেন।
লেখক: বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা
ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী