মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবীর প্রতি নজর দেওয়া প্রয়োজন

0
840
প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার
প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার

প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার: বিগত কয়েকদিন যাবত মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিশৃংখলা পরিলক্ষিত হচ্ছে। নিয়োগ বিধি সংশোধন করে বেতন বৈষম্য নিরসনের দাবীতে গত ২৬ নভেম্বর থেকে স্বাস্থ্য পরিদর্শক. সহকারী স্বাস্থ্য পরিদর্শক ও স্বাস্থ্য সহকারীরা আন্দোলনে নেমেছে। যার ফলে ইপিআই কার্যক্রমসহ যাবতীয় কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

বাংলাদেশ হেলথ এ্যাসিসট্যান্ট এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় পরিদর্শক সমিতি, বাংলাদেশ স্বাস্থ্য বিভাগীয় মাঠ কর্মচারী এসোসিয়েশন নামের সংগঠনের ডাকে এ কর্ম বিরতি চলছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকেও কোন কার্যকরী উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্যতম হচ্ছে স্বাস্থ্য।

স্বাস্থ্যকর্মীরা যেসব কাজ করছে সেগুলি মানুষের জীবনের দীর্ঘমেয়াদী কিছু সমস্যার সমাধান শুরুতেই আটকে দিচ্ছে। তাদের কার্যক্রমের প্রভাব সরাসরি পরিলক্ষিত না হলেও মানব জীবনের বর্তমান প্রেক্ষাপটের শারিরিক সুস্থ্যতার গুরুত্বপূর্ণ দিক গুলো সামাল দিচ্ছে। বিশেষ করে আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্র ব্যবস্থায় স্বাস্থ্য খাতে অধিক পরিমাণে ব্যয় করা সাধারণ জনগণের পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

তাছাড়া গ্রামের মানুষের পক্ষে সরকারের প্রদত্ত স্বাস্থ্য সেবার সুফল পাওয়া অত্যন্ত জটিল। গ্রামীণ এলাকায় মানুষের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে এসব স্বাস্থ্যকর্মীরা। কিন্তু দীর্ঘদিনেও মাঠ পর্যায়ে এদের দাবীর প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সরকার পক্ষের বারবার আশ্বাস কর্মচারীদের মনে বিরক্তির সৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে এমন একটি প্রোগ্রামকে সামনে রেখে তার এ কর্মসূচী হাতে নিয়েছে।

সম্প্রতি তাদের আন্দোলনের ফলে হাম-রুবেলার টিকা কর্মসূচীর মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হুমকির মুখে চলে এসেছে। ইতোমধ্যে এ টিকা দেয়ার তারিখ বেশ কয়েকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। এমনিতেই সারা পৃথিবী আজ করোনা আক্রান্ত তার উপর এসব গুরুত্বপূর্ণ টিকা সফলভাবে সঠিক সময়ে প্রয়োগ করতে না পারলে জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে চলে যাবে। আর টিকার এসব কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়নের জন্য সরকারের হাতে বিকল্প এত পরিমাণে দক্ষ জনবলও নেই।

সরকার ইতোমধ্যে এসব টিকা মাঠ পর্যায়ে প্রদানের লক্ষ্যে বিকল্প হিসেবে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার, নার্স, পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শক, পরিবার কল্যাণ সহকারীদের উপর এ দায়িত্ব অর্পণ করেছে। মনে রাখতে হবে বিকল্প দিয়ে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয় । কারন এটি একটি জটিল কাজ আর এ জটিল কাজ অন্য বিভাগের লোক দিয়ে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা কঠিন। তার মানে হচ্ছে সরকার অনেক হার্ড লাইনে। মাঠ পর্যায়ে এসব কার্যক্রম বাস্তবায়নে বর্তমানে যাদের নিয়োজিত করা হয়েছে তাদের অবস্থা বুঝে মনে হয় এটা বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে চ্যালেঞ্জ হয়ে যাবে। প্রকৃত পক্ষে এই কার্যক্রম এদের দ্বারা মাঠ পর্যায়ে আদৌ কতটুকু বাস্তবায়ন সম্ভব তা সময়ই বলে দিবে। আর যদি হয়ও তাহলের দেখার বিষয় সরকারের চ্যালেঞ্জ কতটুকু সফলতার সাথে বাস্তবায়ন হয়। আজকে দুপক্ষের যে অবস্থান তাতে প্রশাসনের সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে এ জায়গা থেকে সমাধানের পথে আসা দুরুহ কোন ব্যাপার ছিল বলে মনে হয় না। সবচেয়ে সমস্যার কথা হলো সরকারের কোন উচ্চ পর্যায়ের লোকজন আন্দোলন কারীদের কথা গ্রাহ্যই করছে না বরং হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। যার ফলে এখন মাঠ কর্মীরাই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছে।

আন্দোলনকারীরা দাবী করছেন ১৯৯৮ সালের ৬ ডিসেম্বর এক সমাবেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের দাবী পূরণের আশ্বাস, ২০১৮ সালের ২ জানুয়ারী স্বাস্থ্যমন্ত্রী দাবী মেনে নিয়ে বাস্তবায়নের জন্য কমিটি গঠন এবং এ বছরের ফ্রেব্রুয়ারী মাসে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সচিব দাবী মেনে নিয়ে লিখিত প্রতিশ্রুতি প্রদান করেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত এসব কাজের কোন অগ্রগতি নেই। মাঠ পর্যায়ে গর্ভবতী মা ও শিশু নিবন্ধন করে ১০টি রোগের প্রতিষেধক টিকা, বিদ্যালয় এবং কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা প্রদান, রোগ নিরিক্ষণ করে সন্দেহজনক রোগী বাছাই করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে প্রেরণ, ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন, কৃমি সপ্তাহ বাস্তবায়ন, হাম রুবেলা ক্যাম্পেইন এমন কি করোনার মতো ভয়াবহ ব্যাধিতে জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাচ্ছে এসব স্বাস্থ্য কর্মীরা। যার ফলে ইতোমধ্যে এমডিজি-৪ অর্জন, সাউথ সাউথ পুরষ্কার, দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠ টিকাদানকারী দেশ, হাম রুবেলা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের পুরষ্কার ও গ্লোবাল এলায়েন্স ফর ভ্যাকসিনেশন এন্ড ইমুনাইজেশন কর্তৃক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ভ্যাক্সিন হিরো সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে।

এসব পুরষ্কারের অবদান সত্যিকার অর্থে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের অবদান এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। এদের কার্যক্রমের ফলে মাতৃমৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর হার কমে আসা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া ও পোলিও মুক্ত বাংলাদেশ, হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন সফলভাবে বাস্তবায়ন, যক্ষা নিয়ন্ত্রণ, গুটি বসন্ত মুক্ত, ধনুষ্টঙ্কার মুক্ত করা সম্ভব হয়েছে। এসব অর্জনের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মীদের অবদানই মূখ্য। এমনকি করোনা মহামারী কালে মাঠ পর্যায়ে স্বাস্থ্য কর্মীরা স্যাম্পল কালেকশন থেকে শুরু করে হোম কোয়ারেন্টাইন এর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তাহলে এদের অবদানকে আমরা কেন অস্বীকার করছি সেটা বোধগম্য নয়। কোন ব্যক্তির কাজকে অস্বীকার করে তার কাছ থেকে ভালো কাজ আশা করাটাও বোকামি। এদেরকে গ্রামীণ সাধারণ মানুষ ডাক্তার নামেই চিনে এমনকি জনসাধারণ এদের কাছ থেকেই চিকিৎসার প্রাথমিক সেবাটা পেয়ে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো এদের এব্যাপারে যথেষ্ট প্রশিক্ষণের কোন ব্যবস্থা সরকার এ পর্যন্ত গ্রহণ করেনি।

স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠ পর্যায়ের এত সব কাজ বাস্তবায়ন করার পরও এদের নিয়োগ বিধি সংশোধন করে দক্ষ জনবল নিয়োগ দেয়ার কোন ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়নি। অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় যারা এসব মন্ত্রনালয় পরিচালনা করছেন তারা কেবল মাত্র উপরের দিকেই নজর দিচ্ছেন। নজর দেয়ার সবটুকু আলোই চলে যাচ্ছে হাসপাতাল ও ডাক্তার কেন্দ্রিক। যার ফলে বঞ্চিত হচ্ছে মাঠ পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মীরা। ২৬ হাজার কর্মচারীর এ পরিবারের প্রতি সরকারের নজর যেন আসছেই না। হাম-রুবেলার টিকা কোন মতে বিকল্পদের দিয়ে দেওয়া গেলেও স্থায়ী কার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত ঘটবে এটা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। দুপক্ষেরই সহনশীল অবস্থানে থেকে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা হলো আমাদের দেশে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যেন সব কিছুতেই প্রদানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ করতে হবে। তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় সব কিছুই যদি প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে হয় তাহলে এতসব দায়িত্ব প্রাপ্ত লোকের কি প্রয়োজন? আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এত বৃদ্ধি পেয়েছে যে সঠিক কাজটাও সঠিক সময়ে করা যাচ্ছে না যার ফলে সরকারের অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। আবার অনেক বিষয় আছে যে গুলি প্রধানমন্ত্রীকে জানতেও দেয়া হচ্ছে না বলেই মনে হয়।

মাঠকর্মীদের দাবী পশু , কৃষি, মৎস্য বিভাগের যারা সেবা দিয়ে আসছে তাদের ক্ষেত্রে ডিপ্লোমাধারীদের নিয়োগ দেওয়া হলেও মানুষের সেবা দেয়ার মতো জটিল জায়গায় ডিপ্লোমাধারীদের নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। দীর্ঘদিন যাবত হবে হবে বলেও হচ্ছে না। অনেক দিনের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জেগে উঠেছে। টিকাদানে বাংলাদেশ আজ পৃথিবীতে রোল মডেল তারপরও মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা বঞ্চিত বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে। এ অবস্থা থেকে সমাধানের পথে যেতে হলে দুপক্ষের মাঝে আলোচনা সাপেক্ষে তাদের যৌক্তিক দাবী গুলো আস্তে আস্তে পূরণ করে হলেও এ অচলাবস্থা নিরসন করা জরুরি। নতুবা জনস্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়বে এতে কোন সন্দেহ নেই। মাঠকর্মীরা চেয়ে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর মুখের আশ্বাস তাহলেই হয়তো আন্দোলনকারী কর্মীরা ফিরে যেত তাদের কর্মস্থলে আর বাস্তবায়িত হতো হাম-রুবেলার মতো জটিল ক্যাম্পেইন।

লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী
প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here