হিমুর চরিত্রটি দ্বারা হুমায়ুন আহমেদ কী বোঝাতে চেয়েছেন?

 

এখন আমরা যদি বাস্তবতার নিরিখে চিন্তা করি তাহলে হিমুকে আমরা বদ্ধ উন্মাদ ভাববো। সেটা ভাবাই তো স্বাভাবিক। কারণ আমরা মানুষ। আমরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। আমাদের জীবনে রয়েছে মহান লক্ষ্য। আমাদেরকে সে লক্ষ্যেই কাজ করে যেতে হবে। আমাদের এক দণ্ড জিরুনোর সময় কই?

এ জায়গায় আমি আপনাদেরকে একটু থামাবো। একটা প্রশ্নের জবাব দিন তো। আমাদের জীবনের লক্ষ্যটা আসলে কি?

জন্মের পর আমাদেরকে লক্ষ্য বেধে দেয়া হলো পড়াশোনা করো, ক্লাসে ফার্স্ট হও, প্রত্যেক পরীক্ষায় একশো নম্বর আনো। তাই সেই লক্ষ্যের পিছনেই আমরা ছুটতে শুরু করলাম। আমরা অনেকে সেই লক্ষ্যে সফলও হলাম।

পড়াশোনা শেষে এবার লক্ষ্য বেঁধে দেয়া হলো চাকরি করো, বা ব্যবসা করো। দিনরাত কাজ করো। টাকা কামাও। সেই টাকায় পরিবারের ভরণপোষণ করো। থামলে চলবেনা। ছুটে চলো।

এবার পালা বিয়ে করার। পরবর্তী প্রজন্মের আগমন, তাদেরকে সঠিকভাবে শিক্ষা দিয়ে বড় করা। এরপর একসময় বয়স হলে রিটায়ার্ড হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা। জন্মজন্মান্তর ধরে এভাবেই তো জীবন কাটিয়ে আসছে মানবসন্তানেরা।

একটা জিনিস আমার মাথায় ঢুকলো না। মানবসন্তান এর জীবনের মহত্ত্ব টা কোথায়? এ তো শুধু আসা যাওয়ার মিছিল, মাঝখানে কিছুক্ষণ নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য যুদ্ধ করা।

একটা জিনিস আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে আমরা আমাদের জীবন এবং আমাদের জীবনের লক্ষ্যকে যতটা মহান মনে করি, তা এতটা মহান কিন্তু নয়। এই মহাকাশে আমরা এক অগুরুত্বপূর্ণ ধূলিকণা। আমাদের অনুপস্থিতি মহাবিশ্বে এতটুকুও পার্থ্যক্য সৃষ্টি করবেনা।

তাহলে কেন এত কর্মযজ্ঞ? কেন এত ব্যস্ততা? ঠিক এই জায়গাতেই হিমুর আবির্ভাব ঘটে। হিমু তো তার কাযকর্মের মাধ্যমে আমাদের এটাই বুঝাতে চেয়েছে যে, কেন এত ছুটছো? একটু থামো, পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করো। খালি পায়ে হাটো, মাটির শীতল স্পর্শ নাও, এই মাটিতেই তো একদিন মিশে যেতে হবে। কখনো আবার গভীর জোছনা উপভোগ করো। চাঁদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকো। কোনো অর্থ বের করার চেষ্টা করোনা। সব কিছুই অর্থহীন।

বরং অর্থহীন হওয়াতেই জীবনের সার্থকতা। তাই অর্থ বের করার চেষ্টা অনর্থক। এত ব্যস্ততার মানেই হয় না। কারণ তোমার জীবনের বেশিরভাগ ভাগ্য আগে থেকেই নির্ধারিত হয়ে আছে। তোমার চেষ্টায় খুব বেশি পার্থ্যক্য আসবেনা।

হিমু অনেকসময় একজন অপরিচিত পথচারীর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দেয়। সে ব্যক্তি হিমুর দিকে তাকিয়ে দেখে তার পরনে হলুদ পাঞ্জাবি, কিন্তু পায়ে জুতা নেই, অথচ সে দার্শনিক কথাবার্তা বলছে। এই দেখে সে ব্যক্তি হঠাৎ করে ভড়কে যায়। সে হিমুকে ভাবে ছিনতাইকারী নয়তো ছিঁচকে চোর। তাই সে হিমুকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। হিমু তাকে ভয় পাওয়ানোর জন্য তার আরও কাছে যায়। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা বলে তার মাথা ঘুরিয়ে দেয়। লোকটি এবার হাঁটা শুরু করে, পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে হিমুর থেকে।

এখানে লোকটি আসলে হিমুর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে না। সে পালিয়ে যাচ্ছে একটা সত্য থেকে। সাধারণত মানুষ যে সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। কিন্তু হিমু চোখে আঙ্গুল দিয়ে সবাইকে সে সত্য দেখায় বলে সবাই হিমুকে ভয় পায়, তাকে পাগল আখ্যা দেয়।

সত্যটি হলো এই মহাশূন্যে ঝুলে থাকা গ্রহটিতে এক মহাশক্তিধর সত্তা আমাদের সৃষ্টি করে ছেড়ে দিয়েছেন। আমাদের জীবনের কোনো লক্ষ্য তো দূরে থাক আমরা তো ঠিকমত আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কেই জ্ঞাত নই। আমাদের জীবন টা আসলে কি? আমরা সবাই কি ম্যাট্রিক্স মুভির মত কম্পিউটার সাইম্যুলশনে বাস করছি? নাকি আমরা কোনো এক দৈত্যের স্বপ্নে বাস করছি? তার স্বপ্ন ভাঙ্গলেই আমাদের জীবনের সমাপ্তি হয়ে যাবে?

Leave a Comment

error: Content is protected !!