অপারেশন সার্চলাইট

অপারেশন সার্চলাইট (ইংরেজি: Operation Searchlight) ১৯৭১সালে ২৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত পরিকল্পিত গণহত্যা, যার মাধ্যমে তারা ১৯৭১ এর মার্চ ও এর পূর্ববর্তী সময়ে সংঘটিত বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে চেয়েছিল। এই গণহত্যা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের আদেশে পরিচালিত, যা ১৯৭০ এর নভেম্বরে সংঘটিত অপারেশন ব্লিটজ্‌ এর পরবর্তি অনুষঙ্গ।

অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ এর মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) সব বড় বড় শহর দখল করে নেয়া এবং রাজনৈতিক ও সামরিক বিরোধীদের এক মাসের ভেতর নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। বাঙালিরা তখন পাল্টা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে,যা পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের ধারণার বাইরে ছিল। মে এর মাঝামাঝি সময়ে সকল বড় বড় শহরের পতন ঘটার মধ্যে দিয়ে অপারেশন সার্চলাইটের প্রধান অংশ শেষ হয়। এই সামরিক আক্রমণ ১৯৭১ সালের গণহত্যাকে ত্বরান্বিত করে। এই গণহত্যা বাঙালিদের ক্রুদ্ধ করে তোলে যে কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালি অফিসার ও সৈনিকেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয় এবং বহু মানুষকে শরণার্থীরূপে ভারতে আশ্রয় নিতে হয়।

এই ভয়াবহ গণহত্যা ১৯৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায় এবং বাঙালিরা দখলদারী পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতারিত করার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। পরিণতিতে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ই ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ড “মিত্র বাহিনী” এর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

অপারেশন সার্চলাইট
মূল যুদ্ধ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
তারিখ ২৫ মার্চ, ১৯৭১ – ২৬ মে, ১৯৭১.
অবস্থান
বাংলাদেশ, তথা পূর্ব পাকিস্তান
ফলাফল বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ
বিবাদমান পক্ষ
পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্য ও সাধারণ স্বেচ্ছাসেবী পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ (১৭ এপ্রিল- ১৬ ডিসেম্বর) কর্ণেল (অবঃ) এম. এ. জি. ওসমানী (১০ এপ্রিল- ১৬ ডিসেম্বর)

অপারেশন জ্যাকপট
লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা

জেনারেল শ্যাম মানেকশ’

রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান
লে. জেনারেল টিক্কা খান (মার্চ-সেপ্টেম্বর)লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী
(১১ এপ্রিল-১৬ ডিসেম্বর)
শক্তি
বাঙ্গালী বাহিনী:ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ~৬০০০ সেনা আধা সামরিক বাহিনী
ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস :~ ১৩,০০০ সেনা
সাধারণ সেচ্ছাসেবী: অজ্ঞাতসংখ্যকরি-ইনফোর্সমেন্ট: অজ্ঞাতসংখ্যক নিরস্ত্র প্রাক্তন-সেনাসদস্য ও সাধারণ জনগণ
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী: ১৪ পদাতিক ডিভিশন, ১৮,০০০+ সৈন্য, ১ রেজিমেন্ট (৭৫টি) এম-২৪ চ্যাফি ট্যাংক।

উপসামরিক বাহিনী: ~২,০০০ ইপিআর,মুজাহিদ এবং মিজোদের অজ্ঞাতসংখ্যক বাহিনী

রি-ইনফোর্সমেন্ট: পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা ৯ ও ১৬ পদাতিক ডিভিশন
পাকিস্তান বিমান বাহিনী: ২০টি এফ-৮৬ স্যাবর যুদ্ধবিমান, ৩টি টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান, আটটি হেলিকপ্টার, লকহিড সি-১৩০ হারকিউলিস পরিবহন বিমান।

পাকিস্তান নৌবাহিনী:

৪টি গানবোট, ১টি পেট্রোল বোট, ১টি ডেস্ট্রয়ার .

হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
মুক্তিবাহিনী: অজ্ঞাত সংখ্যক, ~কয়েক হাজার, ~৪,০০০+ যুদ্ধবন্দী। ~৬,০০০ যুদ্ধে নিহত এবং আহত গুটিকয়েক যুদ্ধবন্দী।
নিহত জনসাধারণের সংখ্যা: আনুমানিক কয়েক লক্ষ বাঙালি সাধারণ জনগণ

 

অপারেশনের পরিকল্পনা



পরিকল্পনা পদ্ধতি

২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এ পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর এক বৈঠকে গৃহীত প্রস্তাবনার ভিত্তিতে মার্চের শুরুতে ১৪তম ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের মূল পরিকল্পনা তৈরি করেন। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েতা হতে ১৬তম ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং খরিয়ান থেকে ১৯তম ডিভিশনকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়ার আদেশ দেয়া হয়।

পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি লে জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এস এম আহসান পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের উপর সামরিক হামলার বিরোধী ছিলেন বলে অপারেশনের পূর্বেই তাদেরকে দায়িত্ব হতে অব্যাহতি দেয়া হয়। লে জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও জিওসি করে পাঠানো হয়। মার্চের ১৭ তারিখ পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সিওএস জেনারেল হামিদ টেলিফোন করে জেনারেল রাজাকে অপারেশনের পরিকল্পনা করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৮ মার্চ সকালে ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি কার্যালয়ে বসে জেনারেল রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি অপারেশনের পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনাটি জেনারেল ফরমান নিজ হাতে হালকা নীল রঙের একটি অফিস প্যাডের ৫ পাতা জুড়ে লিড পেন্সিল দিয়ে লিখে নেন।

জেনারেল ফরমান অপারেশনের সিদ্ধান্ত, এবং সাফল্যের শর্ত ইত্যাদির সীমা তৈরি করেন এবং জেনারেল খাদিম সেনাদলের স্থান বিতরন, বিভিন্ন ব্রিগেড ও ইউনিটের উপর সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব বণ্টন ইত্যাদি কাজ তদারকি করেন। এটা ধারণা করা হয় যে বাঙালি সেনারা অপারেশনের শুরুর সময় বিদ্রোহ করবে, তাই পরিকল্পনাকারীরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলাপকালে বাঙালি সৈন্যদের অপারেশনের পূর্বেই নীরস্ত্র করার এবং বাঙালি রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতারের প্রস্তাব দেন।

‘অপারেশনের সব কিছুই নির্ধারিত হল।’ – হাতে লিখিত পরিকল্পনাটি ২০ মার্চে আবার জেনারেল হামিদ এবং লে জেনারেল টিক্কা পর্যালোচনা করেন। জেনারেল হামিদ তাৎক্ষনিকভাবে বাঙালি সেনা ইউনিটগুলোকে নীরস্ত্র করার সিদ্ধান্ত নিলেও শুধুমাত্র ই পি আর, আর্মড পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীদের নীরস্ত্র করার অনুমতি দেন। ইয়াহিয়া খান তার সাথে এক বৈঠকের সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতারের পরিকল্পনাকে প্রত্যখ্যান করেন। পুণঃনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয় এবং বিভিন্ন এলাকার কমান্ডারদের কাছে বিতরন করে দেয়া হয়।

অপারেশন শুরু হয় ঢাকায় ২৫ মার্চ রাতের শেষ প্রহরে এবং অন্যান্য গ্যারিসনকে ফোন কলের মাধ্যমে তাদের জিরো আওয়ারে (অপারেশন শুরুর পূর্বনির্ধারিত সময়) তাদের কার্যক্রম শুরু করার জন্য সতর্ক করে দেয়া হয়। ঢাকার সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন রাও ফরমান আলি এবং অন্যান্য সব স্থানের সৈন্যদের কমান্ডে ছিলেন জেনারেল খাদেম। জেনারেল টিক্কা এবং তার কর্মকর্তারা ৩১তম কমান্ড সেন্টারের সব কিছু তদারকি করা এবং ১৪তম ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে উপস্থিত ছিলেন।

পরিকল্পনার প্রধান অংশগুলো



গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহ

পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারিদের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অপারেশনের মূল লক্ষ্য ছিল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং সশস্ত্র বাহিনীর যারা সামরিক শাসনকালে আওয়ামী লীগকে সমর্থন জুগিয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া। অপারেশনের সর্বোচ্চ সার্থকতার জন্য ধুর্ততা, চমকে দেয়া, প্রবঞ্চনা, এবং দ্রুতগতি ইত্যাদি বিষয়ের উপর জোড় দেয়া হয়। নির্বাধ এবং সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। সাধারণ জনবসতি এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে অনুসন্ধান এবং আক্রমণের কর্তৃত্বও প্রদান করা হয়।

সাফল্যের নিয়ামক গুলো

  1. সারা পূর্বপাকিস্তানে একযোগে অপারেশন শুরু করতে হবে।
  2. সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক ও ছাত্র সংগঠনের নেতা, সাংস্কৃতিক সংগঠনের সথে জড়িত ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকদের গ্রেফতার করতে হবে।
  3. ঢাকায় অপারেশন ১০০% সফল হওয়া বাধ্যতামূলক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল এবং তল্লাশী করতে হবে।
  4. সেনানিবাসকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনে উন্মুক্ত ও সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অস্ত্র ব্যবহারের কর্তৃত্ব প্রদান করা হয়।
  5. টেলিফোন, টেলিভিশন, রেডিও ও টেলিগ্রাফ সহ সকল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিতে হবে।
  6. সকল পূর্বপাকিস্তানি (বাঙালি) সৈন্যদলকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ কেড়ে নিয়ে নিস্ক্রিয় করে দিতে হবে।
  7. আওয়ামী লীগের মনে ভুল ধারণা সৃষ্টি করে তাদের ব্যস্ত রাখার জন্য ইয়াহিয়া খান আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার অভিনয় করবেন। এমনকি ভুট্টো যদি আওয়ামী লীগের প্রস্থাবে রাজি হয়ে আলোচনা চালিয়ে যেতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন, তবুও ইয়াহিয়া আলোচনা চালিয়ে যাবেন।

পরিকল্পনায় পূর্ব নির্ধারিত আক্রমণাত্মক অপারেশন পরিচালনার জন্য চিহ্নিত স্থানগুলো ছিল- ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর, রাজশাহী, রংপুর, সৈয়দপুর এবং সিলেট। এসব স্থানে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের সমাবেশ বেশি ছিল। পূর্বপাকিস্তানের অন্যান্য স্থানে অবস্থিত সৈন্যদল এবং প্যরা মিলিটারি বাহিনীরা তাদের নিজ নিজ এলাকা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে রয়ে যাবে এবং প্রয়োজন হলে অন্যান্য স্থানে প্রাথমিক অপারেশনের সময় শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে যোগ দেবে। ঢাকা সম্পূর্ণ নিরাপদ হলে পাকিস্তানের ৯ম এবং ১৬তম ডিভিশনের সৈন্যরা শক্তিবৃদ্ধির জন্য বিমান যোগে ঢাকা চলে আসবে। যেসব শহরে বিমানঘাঁটি আছে(চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, রংপুর, কুমিল্লা) সেসব শহরে সরাসরি ঢাকা থেকে সি-১৩০ (C-130) বিমান অথবা হেলিকপ্টার ট্রুপস এর মাধ্যমে শক্তি বৃদ্ধি করা হবে।

যদিও পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানকে দমন করার জন্য কোন নির্দিষ্ট সময় বেধে দেয়া হয় নি, এটা ধারণা করা হয় যে রাজণৈতিক নেতাদের গ্রেফতার এবং বাঙালি সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীদের নীরস্ত্র করার পর সাধারণ জনগণদের ভয় দেখিয়ে এক সাপ্তাহের মধ্যে সামরিক শাষনের আওতাভূক্ত করা হবে। লে জেনারেল টিক্কা বলেন যে ১০ এপ্রিলের পর আর কোন বাধা বিপত্তি থাকবে না।

পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাদের বিন্যাস

অপারেশন সার্চলাইটঃ ২৫ মার্চে পাকিস্তানি ও বাঙালি সৈন্যদের অবস্থান। কয়েকটি ইউনিটের অবস্থান দেখানো হয় নি। ১৪তম পদাতিক ডিভিশনই পাকিস্তানি সেনাদের একমাত্র ডিভিশন যাদের পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭১ এর মার্চে ঘাঁটি ছিল। যেখানে সাধারণ নিয়ম অণুযায়ি তিনটে ব্রিগেড থাকার কথা, সেখানে এই ডিভিশনে চারটি পদাতিক ব্রিগেড ছিল। ৫৭তম পদাতিক বাহিনীকে(পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার জাহানবাজ আরবাব এর অধীনে) ঢাকায়, ৫৩তম পদাতিক বাহিনীকে(পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির অধীনে) কুমিল্লায়, ২৩তম ব্রিগেডকে(পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ খান মালিকের অধীনে) রংপুরে এবং ১০৭তম ব্রিগেডকে(পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার এআর দুররানির অধীনে) যশোরে পাঠানো হয়।
ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার নামের একজন বাঙালি ব্রিগেডিয়ার ছিলেন চট্টগ্রামের কমান্ডে। সাধারণ ভাবে প্রতি ব্রিগেডে ৩ থেকে ৪টি পদাতিক ব্যটেলিয়ন ও একটি ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং আরও কিছু সাহায্যকারী অংশ থাকে। এই চারটি ব্রিগেডে মোট ১২টি পদাতিক ব্যটেলিয়ন ছিল(প্রতি রেজিমেন্টে সাধারণত ৯১৫ জন সৈন্য থাকে) যেগুলোর সব গুলোতে ছিল শুধুমাত্র পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা(প্রধানত পাঞ্জাব, বালুচ, পাঠান এবং সিন্ধিদেরই প্রাধান্য দেয়া হয়)। তাদের ২৫ মার্চের আগেই পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসা হয়। এই ডিভিশনের আরও ছিল ৫টি ফিল্ড আর্টিলারী রেজিমেন্ট, একটি হালকা এন্টি এয়ারক্রাফট রেজিমেন্ট, একটি কমান্ডো ব্যটেলিয়ন(৩য়), যেগুলোর সবগুলোতেই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রাধান্য।
রংপুরে অবস্থানরত ২৯তম অশ্বারোহী রেজিমেন্টই ছিল পুর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত একমাত্র স্বশস্ত্র মিশ্র (যেখানে বাঙালি সৈন্য ছিল) রেজিমেন্ট। ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) এর প্রায় ২০% সৈন্য ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের, যেখানে বিভিন্ন ইউনিট এবং সেনানিবাসের সাহায্যকারী সৈন্যরা ছিল মিশ্র জাতীয়্তার। বেশিরভাগ ইউনিটের ইউনিট কমান্ডার এবং উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাগণ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি।

ঢাকা বিমান ঘাঁটিতে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর ২০টি এফ-৮৬ সাবের জেট এবং ৩টি টি-৩৩ প্রশিক্ষণ বিমান ছিল। সশস্ত্র বাহিনীর এক স্কোয়াড্রন ৪টি এমআই-৮ এবং ৪টি এলট-III হেলিকপ্টার পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়। সি-১৩০ হারকিউলিস বিমানকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অপারেশনের জন্য ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, রংপুরের কাছাকাছি লালমনিরহাটে, সিলেটের কাছাকাছি সালুটি করে, যশোরে এবং ঠাকুরগাঁয়ের কাছে বিমানঘাঁটিগুলো স্থাপন করা হয়।

পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান নৌবাহিনীর চারটি গানবোট (রাজশাহী, যশোর, কুমিল্লা এবং সিলেটে) একটি পেট্রোল বোট (বালাঘাট) এবং একটি পিএনএস জাহাঙ্গির নামে একটি ডেস্ট্রয়ার ছিল। পাকিস্তানি নৌবাহিনীর পিএনএস বাবুর নামের পতাকাবাহী জাহাজ অপারেশন শুরুর পর পূর্ব পাকিস্তানে আসবে। বেশির ভাগ নৌঘাঁটিই ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম ও মংলায়।

পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনীর পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালি ইউনিটসমূহ

১৯৭১ এর মার্চে ৬টি নিয়মিত বাঙালি পদাতিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে উপস্থিত ছিল। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (ইবিআর) যশোরে ১০৭তম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত ছিল। ২য় ইবিআর ঢাকার দক্ষিণে জয়দেবপুরে ৫৭তম ব্রিগেডের সাথে যুক্ত ছিল। ৩য় ইবিআর ২৩তম ব্রিগেডের সাথে সৈয়দপুরে ছিল। এবং ৪র্থ ইবিআর ৫৩তম ব্রিগেডের সাথে কুমিল্লায় ছিল। ৮ম ইবিআর পশ্চিম পাকিস্তানে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল এবং প্রায় ৭৫% সৈন্য ছিল চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে ২০০০ বাঙালি সৈন্য অবস্থান করছিল, যাদের মধ্যে নতুনভাবে তৈরি করা ৯ম ইবিআর ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১০ম ইবিআর ছিল একটি প্রশিক্ষন ইউনিট, যেটি ঢাকায় ১৪তম ডিভিশনের সাথে সংযুক্ত ছিল। বাঙালি অফিসাররা ১ম, ২য় এবং ১০ম ইবিআর এর নেতৃত্বে ছিলেন এবং বাদবাকিগুলোর দায়িত্বে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসাররা।

অন্যান্য বাঙালি সশস্ত্র দল

পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশ বাহিনীর কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার ছাড়া অধিকাংশই ছিল বাঙালি। ১৫০০০ সৈন্যের প্যারামিলিটারি বাহিনী (যার মধ্যে ৮০% বাঙালি) ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) ৭টি সেক্টরে (যেগুলোর সদর দফতর ছিল ঢাকা, ময়মনসিংহ, যশোর, রাজশাহী, দিনাজপুর, সিলেট এবং চট্টগ্রামে) ১৭টি অপারেশনাল উইঙে বিভক্ত ছিল (প্রতি উইঙে ১৫০ জনের ৩-৬ টি কোম্পানি থাকতো) যাদের সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়। ইপিআর কোম্পানীদের প্রায়শই ছোট ছোট সেকশন(১৫-২০জন সৈন্য) এবং প্লাটুনে(২০-৩৫জন সৈন্য) বিভক্ত করে সীমান্তের নিকটবর্তী ক্যম্পে অথবা সীমান্ত ফাঁড়িতে ছড়িয়ে দেয়া হত। যেখানে সেনাবাহিনীর কোম্পানীর দায়িত্বে সাধারণ ভাবে ক্যপ্টেন ও মেজররা থাকতেন, সেখানে ইপিআর কোম্পানীদের কমান্ডের দায়িত্বে থাকতেন জিসিও/এনসিওরা এবং ইপিআর উইংদের ভারি অস্ত্র হিসাবে শুধুমাত্র হালকা ট্যঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র ও মর্টার দেয়া হত।

অপারেশনের পূর্বে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ



অপারেশনে নামার আগেই যাতে সংশ্লিষ্ট সব পাকিস্তানি ইউনিট কমান্ডার তাদের দায়িত্ব বুঝে নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল অপারেশনর সার্চলাইটের পরিকল্পনাকারীদের। আর এই কাজটি করা দরকার ছিল সম্পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় রেখে। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করা, অস্ত্রশস্ত্রের যোগান, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত সৈনিক পূর্ব পাকিস্তানে আনা, আঞ্চলিক সেনানায়কদের কার্যবিবরণী প্রদান- এই সব কিছুই করা প্রয়োজন ছিল কোন সন্দেহের উদ্রেক না ঘটিয়ে।

২৪ ও ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি জেনারেলদের একটি দল হেলিকপ্টারে করে প্রধান প্রধান গ্যারিসনগুলো পরিদর্শন করেন এবং গ্যারিসন কমান্ডার ও অপারেশনের অন্যান্য সিনিয়র পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের বিভিন্ন নির্দেশনা দেন। এই দলের সাথে ছিলেন জেনারেল হামিদ, জেনারেল মিট্টা, কোয়ার্টারমাস্টার জেনারেল এবং প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার কর্নেল সাদউল্লাহ। জেনারেল ফরমানকে যশোরে পাঠানো হয়, জেনারেল খাদিম নিজে কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের গ্যারিসন কমান্ডারদের ব্রিফ করেন এবং ব্রিগেডিয়ার এল ইদ্রুস ও কর্নেল সাদউল্লাহ রংপুর সফরে যান।

সকল ক্ষেত্রে পূর্ণ গোপনীয়তা বজায় ছিল। না জানলেই নয় এমন কিছু ক্ষেত্রে কেবল গুটিকয়েক লেফটেন্যান্ট কর্নেলকে বিস্তারিত জানানো হয়েছিল। কিছু বাঙালি কর্মকর্তা পাকিস্তানিদের ঘনঘন ব্রিফিং দেখে সন্দেহ করেছিলেন কিছু একটার, কিন্তু ব্রিফিং এ কি ঘটেছে সে সম্পর্কে আক্রমণের পূর্বে তাদের কোন ধারণাই ছিল না।

রসদপত্র ব্যবস্থাপনা

মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে মেজর জেনারেল কামার আলি মির্জা এবং ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব আসেন রসদপত্র ব্যবস্থাপনার জন্য, মূল কারণ ছিল তখন অসহযোগিতার কার্যকলাপের কারণে সেনানিবাসগুলোতে খাদ্য সরবরাহ বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছিল। অস্ত্রের মূল ভাণ্ডার ছিল ঢাকার অদূরে অবস্থিত রাজেন্দ্রপুরে এবং ৯০০০ টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ চট্টগ্রামে এমভি সোয়াত নামের একটি জাহাজে খালাসের অপেক্ষায় ছিল। সুতরাং জাহাজ থেকে রসদপত্র খুব দ্রুত খালাসের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। ততোদিনে ১৩ এফএফ এবং ২২ বালুচ ঢাকায় পৌঁছে গেছে, পাকিস্তান থেকে পিআইএ ফ্লাইট এ করে বিশেষ যাত্রীরা ঢাকায় আসতে শুরু করেছে। পাকিস্তানিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সফলতা নিশ্চিত করতে ২৫ মার্চের আগেই পশ্চিম থেকে পুরো একটি ব্রিগেড পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো। ধীরে ধীরে সৈন্য ও রসদপত্র পাঠানোটা সেই মহাপরিকল্পনারই অংশ ছিল। পূর্বে আসা নতুন সৈনিকদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের অনেক নতুন নতুন ব্যবস্থা করতে হয়েছিল, সাপ্লাই ইউনিট এর বাঙালি সদস্যরা এটা বুঝতে পেরেছিল আগেই। অবশ্য এই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে খুব বেশি অসুবিধা হয় নি, এটা অপারেশনের কোন ক্ষতিও করেনি। ব্রিগেডিয়ার হ্যারিসন রসদপত্র ব্যবস্থাপনার জন্য ঢাকায় থেকে গিয়েছিলেন, পশ্চিমে কার্যক্রম সামাল দিতে ফিরে গিয়েছিলেন জেনারেল মির্জা।

সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অদল বদল

সফলতা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বাহিনী বাঙালি কর্মকর্তাদের স্পর্শকাতর স্থানগুলো থেকে বদলী করে দিয়ে সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী মোতায়েন করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত দুটি পাকিস্তানি ইউনিট, ২৫তম পাঞ্জাব ও ২০তম বেলুচ, এর প্রত্যাবর্তন পিছিয়ে দেয়া হয়, তার ওপর ২৫ মার্চের আআগেই পশ্চিম থেকে ঢাকায় উড়ে আসে ১৩তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ২২তম বেলুচ রেজিমেন্ট। গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য ২৫ মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কোন গ্যারিসনে প্রথমেই অতিরিক্ত সৈন্য পাঠানো হয় নি।

ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার নীরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গুলি বর্ষণে অস্বীকৃতি জানিয়ে এমভি সোয়াত এর মালামাল খালাসের কাজে বাঁধা সৃষ্টি করলে তাকে ২৪ মার্চ তার পদ থেকে অব্যাহতি দেন জেনারেল খাদিম। তাকে এই বলে অব্যাহতি দেয়া হয়ে যে তার এখন জয়দেবপুরে গিয়ে ২ ইবিআর এর কাছে রিপোর্ট করতে হবে, তার বদলে ব্রিগেডিয়ার এম এইচ আনসারি চট্টগ্রাম এলাকার দায়িত্ব পান। মার্চের ২২ তারিখ ঢাকায় অবস্থানরত ৫৭তম ব্রিগেড এর ব্রিগেড মেজর মেজর খালেদ মোশাররফ কে বদলি করে কুমিল্লায় ৪র্থ ইবিআর এর ২আইসি হিসেবে পাঠানো হয়। ২৩ মার্চ ২য় ইবিআর এর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল মাসুদুল হাসানকে তার পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং ২৫ মার্চ তার দায়িত্ব গ্রহণ করেন লে. কর্নেল রকিবউদ্দিন। অবশ্য পাকিস্তানিরা গণহারে বাঙালি কর্মকর্তাদের বদলি করা থেকে বিরত থেকেছিল, কারণ সেক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা বিনষ্ট হতে পারতো। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সব ছুটির দরখাস্ত বাতিল করে দেয়ার পরও মার্চে পাকিস্তানি কর্তপক্ষ আবার বাঙালি অফিসারদেরকে ছুটি নিতে উদ্বুদ্ধ করে, অন্যদিকে পাকিস্তানি কর্মকর্তাদেরকে কোন ছুটি না নিয়ে সদা সতর্ক থাকতে বলা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও সৈন্যদের পরিবারের সদস্যদেরকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়া হয় এবং তার বদলে সুযোগ সুবিধা মত কিছু পশ্চিম পাকিস্তানি বেসামরিক কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানে এনে রাখা হয়।

২৫ মার্চের পূর্বে বাঙালি ইউনিটগুলোর বিস্তার

অপারেশন শুরুর আগেই সমস্ত নিয়মিত বাঙালি ইউনিটকে একসাথে নীরস্ত্র করার অনুমতি দেননি জেনারেল হামিদ, ফলে পাকিস্তানি নেতৃত্ব অন্যান্য উপায় বাঙালি ইউনিটগুলোর সম্ভাব্য হুমকি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করে।

২৫ মার্চে এবং এর আগের সময়গুলোতে বাঙালি ইউনিটগুলোকে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত করে ফেলা হয়, তাদেরকে সেনানিবাসের বাইরে পাঠানো হয় বিভিন্ন কাজ দেখিয়ে, এক অংশ থেকে আরেক অংশকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়, এবং সবগুলো অংশকেই রেডিও এবং তারহীন যোগাযোগের গ্রিড থেকে যত সম্ভব দূরে রাখা হয়। বাঙালি কর্মকর্তাদের হয় ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয় নয়তো নেতৃত্বের কেন্দ্র বা সরাসরি অপারেশনে নিয়োজিত ইউনিটগুলো থেকে যথাসম্ভব দূরে রাখা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মকর্তারা বাঙালি ইউনিট পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। বাঙালি সৈনিকদের অনেককে ছুটিতে পাঠানো হয়, অনেককে নীরস্ত্র করা হয়, তবে এমনভাবে কাজগুলো করা যাতে কারও মধ্যে কোন সন্দেহের উদ্রেক না হয়।

সাধারণ সময়ের তুলনায় তখন প্রথম ইবিআর এর শক্তি ছিল অর্ধেক, এই ইবিআর কেই শীতকালীন প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্তবর্তী চৌগাছায় পাঠানো হয়, ২৯ মার্চ পর্যন্ত তারা এখানেই ছিল। দ্বিতীয় ইবিআর এর কোম্পানি গুলোকে ঢাকার আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকেজো রাখা হয়। ৩য় ইবিআর এর কোম্পানিগুলোকে ছড়িয়ে দেয়া হয় সৈয়দপুর সেনানিবাসের বাইরে গোড়াঘাট ও পার্বতীপুর এলাকার আশেপাশে। ৪র্থ ইবিআর ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও শমসেরনগর এর মাঝামাঝি এলাকায়। একমাত্র চট্টগ্রামেই নিয়মিত বাঙালি ইউনিটগুলোকে তাদের স্বাভাবিক এলাকা থেকে সরিয়ে নেয়া হয়নি।

পশ্চিম পাকিস্তানের ইপিআর বাহিনীর কোম্পানিগুলোকে শহরগুলোর যেখানেই পারা গেছে সেখানেই মোতায়েন করা হয়েছে। অপরদিকে বাঙালি ইপিআর বাহিনীকে পাঠানো হয়েছে সীমান্তবর্তী এলাকায়। অধিকাংশ ইপিআর ইউনিট তাদের মূল অ্যাকশন এর অঞ্চল থেকে অনেক দূরে ছিল এবং নিজ অবস্থান থেকে বড় শহরগুলোতে পৌঁছতে তাদের অন্তত ১ দিন লাগতো। ২৪ অথবা ২৫ মার্চ রাতে ইপিআর এর বেতার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়।

অপারেশন সার্চলাইটঃ ২৫/২৬ মার্চ থেকে ১০ এপ্রিল



এটি হচ্ছে ২৫ মার্চ হতে ১০ এপ্রিল সময়ে অর্থাৎ অপারেশন যে সময়ের শেষ হয় সে সময়ে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী কোন কোন স্থানে নিয়োজিত ছিল এবং সামরিক আক্রমণের ফলাফলের পূর্ন বিবরন। যেসব স্থানকে অপারেশন সার্চলাইটে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে এখানে শুধু সেগুলোর বিবরন আছে, সারা পুর্ব পাকিস্তানে বাঙালিদের প্রতিরোধের কথা নেই। কোন কোন স্থানে ২৫ মার্চেই পাকিস্তানি আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু হবার সাথে সাথেই বাঙালি বাহিনীর সাথে সাথে পাকিস্তানিদের সংঘর্ষ বেধে যায়। অন্যান্য স্থানে ৩০ মার্চের আগে কোন সংঘর্ষ দেখা দেয় নি।

ঢাকা

অপারেশন সার্চলাইটঃ ২৫ মার্চ ১৯৭১ এ ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান প্রধান লক্ষ্যবস্তু। মানচিত্রটি সঠিক মাপে নেই। মেজর জেনারেল ফরমানের নেতৃত্বে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নিম্ন লিখিত লক্ষ্য ছিলঃ-
  • রাত ১১টায় কারফিউ জারি করা এবং টেলিফোন/টেলিগ্রাফ/রেডিও স্টেশন এবং সকল প্রকার পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া।
  • ঢাকা শহরের সড়ক, রেল ও নৌ-পথের দখল নিয়ে সারা শহর বিচ্ছিন্ন করে ফেলা এবং নদীতে টহল জারি করা।
  • অপারেশন চলাকালীণ সময়ের মধ্যে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের আরও ১৫ জন বড় নেতাদের গ্রেফতার করা।
  • ধানমন্ডি এলাকায় এবং হিন্দু এলাকাগুলোতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সার্চ (খোঁজ) করা।
  • ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইপিআর সদর দফতর, এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইন ধ্বংস ও পরাভূত করা এবং ২য় ও ১০ম ইবিআর কে নীরস্ত্র করা।
  • গাজিপুর অস্ত্র কারখানা এবং রাজেন্দ্রপুরের অস্ত্রগুদাম দখল ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

পাকিস্তানি সেনারা: পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দফতরের সাথে যুক্ত হয়ে ১৪তম ডিভিশন এবং ৫৭তম ব্রিগেডও ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থান করছিল। যেসকল নিয়মিত সেনা ইউনিটগুলো উপস্থিত ছিল সেগুলো হলোঃ ৫৭তম ব্রিগেড যার সাথে আরও ছিল; ১৮ এবং ৩২তম পাঞ্জাব (সি.ও লে.কর্নেল তাজ) রেজিমেন্ট, ১৩তম সীমান্তবর্তী রেজিমেন্ট, ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট, ৬০৪তম ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা/গুপ্ত) ইউনিট এবং ৩১তম ভূ-গোলন্দাজ বাহিনী (সি.ও লে.কর্নেল জাহিদ হাসান)। ১৪তম ডিভিশন সদর দফতরের সাথে নিম্নলিখিত ইউনিট গুলো যুক্ত ছিলঃ ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী রেজিমেন্ট (সি.ও লে.কর্নেল সাফফাত আলি-পাকিস্তানি), ৩য় কমান্ডো ব্যটেলিয়নের উপকরন (সি.ও লে.কর্নেল জেড.এ খান-পাকিস্তানি), ১৯তম সংকেত প্রদানকারী রেজিমেন্ট (সি.ও লে.কর্নেল ইফতেখার হুসাইন- পাকিস্তানি), এবং ১৪৯তম পদাতিক বাহিনী। PAF (পাকিস্তানি বিমান বাহিনী) এর সব কিছু তেজগাঁও বিমানবন্দরে জড়ো করা হয়। সাথে ২৯তম অশ্বারোহী রেজিমেন্ট থেকে এক স্কোয়াড্রনের কমপক্ষে ১৪টি M24 শ্যাফি ট্যাঙ্ক ঢাকায় জড়ো করা হয়। এইসকল ইউনিটের সংযুক্তি হিসাবে ৫৭তম ব্রিগেড, ১৪তম ডিভিশন এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড সদর দফতর থেকে অন্যান্য সাহায্যকারী (ইঞ্জিনিয়ারিং, সরবরাহকারী, এবং চিকিৎসা ইউনিট) দল ঢাকায় অবস্থান নেয়।

বাঙালি সশস্ত্রদল: ১০ম ইবিআর (সি.ও লে.কর্নেল মহিউদ্দিন-বাঙালি) ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থানরত ছিল। ২৫০০ ইপিআর সৈন্যদল (১৩তম, ১৫তম এবং ১৬তম উইং, সাথে ইপিআর সদর দফতর উইং এবং সংকেত প্রদানকারী উইং) পিলখানায় ইপিআর সদর দফতরে অবস্থান করছিল। প্রতিটি ইপিআর উইঙে ছিল ৩টি কোম্পানী। যদিও বেশিরভাগ ইপিআর সৈন্যরা পিলখানায় অবস্থান করছিল, তবুও এর মধ্যে দুটি কোম্পানীকে মিরপুরে, দুটি কোম্পানীকে রাষ্ট্রপতি ভবনে এবং একটি কে গভর্নর হাউসে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার নিসার আহমেদ খান ছিলেন পুরো ইপিআর বাহিনীর প্রধান এবং পশ্চিম পাকিস্তানি লে.কর্নেল আনোয়ার হোসাইন শাহ ইপিআর এর ঢাকা সেক্টরের সৈন্যদের কমান্ডার। রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অন্তত পক্ষে ২০০০ সশস্ত্র পুলিশ ছিল। ২য় ইবিআর বাহিনী (সি.ও লে.কর্নেল রাকিব-বাঙালি) ছিল ঢাকার উত্তরে জয়দেবপুরে সাথে এক কোম্পানী ছিল টাঙ্গাইলে, আরও এক কোম্পানী ছিল ময়মনসিংহে এবং একটি ক্ষুদ্র বিচ্ছিন্ন অংশ ছিল গাজিপুরে। ইপিআর এর দ্বিতীয় উইঙের সদর দফতরও (সি.ও ক্যাপ্টেন কামার আব্বাস- পশ্চিম পাকিস্তানি) ছিল ময়্মনসিংহে, যেখানে কোন বাঙালি অফিসার ছিল না।

ঘটনার পরম্পরা: মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি কর্তৃক প্রণীত ঢাকা আক্রমণের পাকিস্তানি পরিকল্পনা ছিল নিম্নরূপঃ

  1. ১৩তম সীমান্তবর্তি সৈন্যদল সেনানিবাসে সংরক্ষিত শক্তি হিসাবে থাকবে এবং নিরাপত্তা প্রদান করবে।
  2. ৪৩তম হালকা বিমানবিধ্বংসী বাহিনী তেজগাঁও বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবে।
  3. ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর বাহিনীকে নীরস্ত্র করবে এবং ইপিআর সদর দফতরের ওয়্যারলেস ব্যবস্থা দখলে নেবে।
  4. ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রাজারবাগ পুলিশ লাইনকে নিস্ক্রিয় করবে।
  5. ১৮তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের দায়িত্ব ছিল পুরান ঢাকা এবং নবাবপুরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
  6. ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্ট মোহাম্মদপুর এবং মিরপুরের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল।
  7. 3 SSG এর একটি প্লাটুন মুজিবকে ধরার দায়িত্বে ছিল।
  8. ২২তম বালুচ এবং ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্রোহীদের নিস্ক্রিয় করার দায়িত্বে ছিল।
  9. ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট এরপর পিলখানার শক্তি বৃদ্ধি করবে।

যখন ২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ২৫ মার্চ সকালের সময়ে পিলখানার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়ে নিল তখন বাঙালি ইপিআর অফিসারদের পাকিস্তানি অফিসাররা পিলখানায় ব্যস্ত রেখেছিল এবং সৈন্যদের প্রায় সবাইকে কাজ বন্ধ রেখে বিশ্রামে পাঠানো হয়। সন্ধ্যার পরপরই সারা শহরে গুজব ছড়িয়ে পরে যে ইয়াহিয়া খান চলে গেছে এবং তখন আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় রাস্তায় হালকা প্রতিবন্ধক বসানো শুরু করে, কিন্তু এই সব প্রতিবন্ধক পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচলে কোন তাৎপর্যপূর্ন বাধার সৃষ্টি করতে পারে নি। যেসব স্বেচ্ছাসেবকরা রাস্তায় প্রতিবন্ধক স্থাপন করছিল তারাই পাকিস্তানি সৈন্যদের দ্বারা প্রথম আক্রান্ত হয়। যদিও অপারেশন রাত ১১টায় শুরু হবার কথা, পাকিস্তানি সৈন্যরা ১১.৩০এ ঢাকা সেনানিবাস থেকে বের হয় কারণ পাকিস্তানি ফিল্ড কমান্ডার চাইছিলেন যে বাঙালি সৈন্যরা যাতে প্রতিক্রিয়া করার কোন সুযোগ না পায়। সেনা বাহিনীকে নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য ৬ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী আক্রমণ শুরু করার আগেই দ্রুততার সাথে ঢাকা শহরের সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

১০ম বাঙালি রেজিমেন্টকে সেনানিবাসে সহজেই নীরস্ত্র এবং পরে নিশ্চিহ্ন করা হয়। ৩১তম ফিল্ড রেজিমেন্টকে ঢাকার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা এবং শহরের উত্তরাংশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর বেলাল এবং লে.কর্নেল জেড এ খানের সাথে নিযুক্ত কমান্ডো বাহিনী অপারেশনের শুরুতেই সহজেই শেখ মুজিবুর রহমানকে ধরতে সক্ষম হয়, কিন্তু আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা কৌশলে গ্রেফতার এড়াতে সক্ষম হন এবং ২৯ মার্চের ভেতর শহর ত্যাগ করেন।

২২তম বালুচ রেজিমেন্ট ইপিআর সদর দফতরে অবস্থিত বেশিরভাগ নীরস্ত্র এবং অসংগঠিত ইপিআর সৈন্যদের আক্রমণ করে সারা রাত যুদ্ধ করার পর পরাজিত ও পরাভূত করতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি বাহিনী কোন বাধা ছাড়াই সহজে মিরপুরে অবস্থানরত ইপিআর বাহিনীকে গ্রেফতার এবং রাষ্ট্রপতি ভবন ও গভর্নর হাউস দখল করে নিতে সক্ষম হয়, কিন্তু অনেকে পালাতে সক্ষম হয় এবং অনেকে মারা পড়ে।

১৮তম ও ৩২তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অনিয়মিত বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রমণ চালায়, আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবীদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাধা প্রদানের চেষ্টাকে পরাভূত করে, ছাত্রনিবাসে অবস্থানরত নীরস্ত্র ছাত্রদের হত্যা করে, সাথে বেশ কিছু অধ্যাপকদেরও হত্যা করে এবং তারপর ২৬ মার্চ সকালের দিকে হিন্দু এলাকা এবং পুরান ঢাকা আক্রমণের জন্য গমন করে। রাজারবাগে অবস্থানরত পুলিশেরা আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সহায়তায় কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়, কিন্তু ধীরে ধীরে পরাজিত হয় এবং যারা বেঁচে ছিল তাদের বেশিরভাগ ধরা পরে অথবা এদিক সেদিক পালিয়ে যায়। পাকিস্তানি সেনারা অপারেশনের সময় জনগণের নিরাপত্তাকে তুচ্ছ করে যথেচ্ছ ভাবে কামান এবং সাঁজোয়া যান ব্যবহার করে। ভোরের মধ্যে শহর দখলে চলে আসে এবং শহরব্যাপি কারফিউ জারি করা হয়। বেঁচে যাওয়া পুলিশ এবং ইপিআর সেনারা শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়, কেউ কেউ বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে জিঞ্জিরায় জমায়িত হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত অনিয়মিত আক্রমণ চলতে থাকে,শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রেফতার করতে না পারা ছাড়া সার্বিক অপারেশনের অন্যান্য সব লক্ষ্য অর্জিত হয়। এছাড়া পাকিস্তানি সেনারা শহীদ মিনার, দৈনিক ইত্তেফাক কার্যালয়, ডেইলি পিপল কার্যালয় এবং রমনার কালী মন্দির ধ্বংস করে দেয়, যাদের একটিরও কোন প্রকার সামরিক প্রয়োজনীয়তা ছিল না।

ধরা পরা বাঙালি সৈন্য এবং ইপিআর ও পুলিশ কর্মকর্তাদের হয় মেরে ফেলা হয় নাইলে কোন বিচার ছাড়া কয়েদে নিক্ষেপ করা হয়। ২৬ মার্চ থেকে ৬ এপ্রিল পর্যন্ত একটি অপারেশন যার নাম দেয়া হয় “GREAT FLY-IN” এর মধ্যে দিয়ে PIA বোয়িং এবং C-130 পরিবহন বিমানের মাধ্যমে ৯ম (২৭তম, ৩১৩তম এবং ১১৭তম ব্রিগেডের সমন্বয়ে গঠিত) এবং ১৬তম (৩৪তম এবং ২০৫তম ব্রিগেড নিয়ে) ডিভিশনকে (মোট ৫টি ব্রিগেড, যার মধ্যে ছিল ১৬টি পদাতিক ব্যটেলিয়ন) ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং এই সেনাবিন্যাসের জন্য প্রয়োজনীয় সব উপকরন পূর্বপাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে পৌছে দেয়া হয়। ২টি মর্টার ব্যটারি এবং ২টি ইপিকাফ (EPCAF) উইঙের প্রতিটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি বনরক্ষা বাহিনীকে একটি গ্রহণযোগ্য সংখ্যায় একত্রিত করে বিভিন্ন স্থানে নিযুক্ত করা হয়।

পাকিস্তানি সেনারা ২৭ মার্চে ২ ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেয়, যখন হাজার খানেক শহরবাসী গ্রামের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যগ করেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৬ মার্চের পর থেকেই শহরের বাইরের দিকে যেতে থাকে এবং পূর্বে ডেমরা, উত্তরে টঙ্গী এবং দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জের দিকে অবস্থান নিয়ে শহরে প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করে দেয়। এপ্রিলের ১০ তারিখের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনারা দক্ষিণে পদ্মা নদী পর্যন্ত এবং উত্তরে টঙ্গী-নরসিংদী পর্যন্ত এলাকা দখল করে নিতে সক্ষম হয়।

ময়মনসিংহ-জয়দেবপুর

২য় ইবিআর দলকে ঢাকার দক্ষিণে জয়দেবপুরের পাঠানো হয়, এবং গাজিপুরের অস্ত্র কারখানা (যেখানে ছোট একটি অস্ত্র গুদাম ছিল) এবং রাজেন্দ্রপুর গোলাবারুদ কারখানা (এখানেও একটি গোলাবারুদের গুদাম ছিল) থেকে দূরে সরিয়ে দেয়া হয়। পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের ভয় ছিল যে এই বাঙালি ইউনিট ঢাকা বিমানবন্দর অথবা সেনানিবাস আক্রমণ করতে পারে এবং ২৫/২৬ মার্চের অপারেশন ভন্ডুল করে দিতে পারে। যদিও লে.কর্নেল মাসুদুল হাসান মেজর কে.এম শফিউল্লাহ কে পাকিস্তানি আক্রমণ সম্পর্কে ২৬ মার্চেই টেলিফোনে বলে দিয়েছিলেন, তা সত্ত্বেও উক্ত ইউনিট ২৭ মার্চের পূর্বে আক্রমণে যায়নি। পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৬ মার্চেই রাজেন্দ্রপুর কারখানার দখল নিয়ে নেয় এবং গুদাম হতে তাদের গোলাবারুদের সরবরাহ পূর্ন করে।

ইপিআর এর ২য় উইং (৪টি কোম্পানী যাদের একটি ময়মনসিংহে এবং অন্যান্য গুলোকে দক্ষিণে নকশী, কারাইতলী এবং লেঙ্গুরাতে পাঠিয়ে দেয়া হয়) এবং তাদের সাথে এক কোম্পানী ২য় ইবিআর এবং পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি মিশ্রিত কোম্পানী ময়মনসিংহে সদর দফতর স্থাপন করে। পাকিস্তানি ইউনিট ইপিআর কোম্পানীকে ২৭ মার্চে আক্রমণ করে কিন্তু পরাস্ত করে ২৮ মার্চে, যে সময়ে ২য় উইঙের অন্যান্য কোম্পানীরা তাদের সাথে অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদের নিস্ক্রিয় করতে থাকে (হয় গ্রেফতার করে সীমান্তে পাঠিয়ে দিয়ে, নাহলে হত্যা করে) এবং মার্চের ২৯ তারিখের মধ্যে ময়মনসিংহ শহরে এবং এর উত্তর ও দক্ষিণে ছড়িয়ে যেতে থাকে। কে এম শফিউল্লাহ এর অধীনে ২য় ইবিআর বাহিনী ২৭মার্চ বিদ্রোহ করে, আংশিকভাবে গাজিপুর অস্ত্রাগার লুট করতে সক্ষম হয় এবং ৩০ মার্চ ময়মনসিংহে পুনরায় মিলিত হয়।

শফিউল্লাহ ২য় ইবিআর এবং ৭টি ইপিআর কোম্পানীর (৪টি ২য় উইং থেকে সরাসরি এবং বাকি ৩টি তৈরি করা হয় ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ এবং আনসার কর্মীদের দিয়ে) দায়িত্ব নেন এবং মার্চের ৩০ তারিখের মধ্যে তার সৈন্যদের টাঙ্গাইল, বাহাদুরবাদ, সিরাজগঞ্জ এবং গফরগাঁয়ে ছড়িয়ে দেন। যে সময় ২য় ইবিআর কিশোরগঞ্জ এবং নরসিংদী হয়ে ঢাকা আক্রমণের উদ্দেশ্য যাচ্ছিল, তখন ৩টি ইপিআর কোম্পানীকে গোপনে আক্রমণ চালাতে ঢাকা পাঠানো হয়। মেজর শফিউল্লাহ ৩১ মার্চে এই পরিকল্পনা বাতিল করে তার ২য় ইবিআর সৈন্যদের নিয়ে কুমিল্লার উত্তরে খালেদ মোশাররফের সৈন্যদলের সাথে মিলিত হন।

মেজর শফিউল্লাহ তার সৈন্যদের নিম্নলিখিত ভাবে ছড়িয়ে দেন: নরসিংদি, আশুগঞ্জ, আজাবপুর, ব্রাক্ষনবাড়িয়া, সারাইল, তালিয়াপাড়া এসব স্থানে এক কোম্পানী করে, ২য় ইবিআর বাহিনীকে তেলিয়াপাড়া, একটি কোম্পানীকে সিলেটের শাদিপুর এবং একটি কোম্পানীকে চট্টগ্রামে মেজর জিয়াকে সাহায্য করতে পাঠান।

পাকিস্তানি সৈন্যরা (২৭তম ব্রিগেড) এপ্রিলের ১ তারিখে ঢাকা ছেড়ে উত্তর দিকে গমন করে, এক সারি টাঙ্গাইল এবং অপর অংশ নরসিংদির দিকে রওনা হয়। ইপিআর বাহিনী টাঙ্গাইলের নিকটে গোপনে তাদের আক্রমণ (অ্যামবুশ) করে, প্রচুর ক্ষয় ক্ষতি সত্ত্বেও পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয় এবং ৯ এপ্রিলে টাঙ্গাইলের পতন ঘটে। দুই সারি সৈন্যদল টাঙ্গাইল থেকে উত্তরে, একসারি জামালপুরের দিকে এবং অন্যদল ময়মনসিংহের দিকে রওনা হয়। বাঙালি সৈন্যদের দ্বারা বারবার গুপ্ত হামলার শিকার হওয়া সত্ত্বেও ১৪ এপ্রিল জামালপুর এবং ২২ এপ্রিল ময়মনসিংহের পতন ঘটে।

PAF (Pakistan Air Force) ৬ এপ্রিলে নরসিংদিতে বোমা হামলা করে ইপিআর বাহিনীকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় এবং পাকিস্তানি সেনাদের সারি (৩১তম বালুচ) ৮ এপ্রিলে নরসিংদির কাছে ইপিআর বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ করে। এই আক্রমণ প্রতিহত করা হয়েছিল্, কিন্তু গোলন্দাজ বাহিনী ও Saber জেটের সহায়তায় পরবর্তি আক্রমণের ফলে প্রতিরক্ষা ভেঙে পরে এবং ১২ এপ্রিল নরসিংদির পতন ঘটে। ২৭তম ব্রিগেড ক্রমাগত আক্রমণের ফলে ময়মনসিংহ, সিলেট এবং কুমিল্লার কিছু অংশ জুনের মধ্যে মুক্ত ও সুরক্ষিত হয়।

চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র তেল শোধনাগার ছিল। যেখানে ছিল একটি বিশাল তেলের গুদাম এবং সব চেয়ে বড় সমুদ্রবন্দর। এই সমুদ্রবন্দরে ৯০০০টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এম ভি সোয়াত অবস্থান করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানি চট্টগ্রাম গ্যরিসনে বাঙ্গালী সৈন্যরা প্রচুর পরিমাণে ছিল, যা পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইপি আর এবং ইপি আর এর বাঙালি অফিসাররা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আগে থেকেই একটি আত্মরক্ষামূলক আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন, কিন্তু সিনিয়র বাঙালি অফিসাররা (ই বি আর সি এর প্রধান প্রশিক্ষক লে কর্নেল এম আর চৌধুরী, এবং মেজর জিয়াউর রহমান) এই বিশ্বাস থেকে ক্যাপ্টেন রফিককে (ই পি আর সেক্টর অ্যাডজুটেন্ট) বিদ্রোহ করা থেকে নিরুৎসাহীত করেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বেসামরিক জনগনের বিরুদ্ধে কোন আক্রমণ চালাবে না, কিন্তু তারা এটা নিশ্চিত করেন যে পাকিস্তানি যে কোন আক্রমণের ঘটনায় তারা অবশ্যই বিদ্রোহ করবেন। এম ভি সোয়াত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সেনানিবাসে নিয়ে যাবার প্র্চেষ্টা ২০-২৫ মার্চের মধ্যে সাধারণ প্রতিবাদকারীদের বাধার কারণে সাময়িক ভাবে ব্যর্থ হয় এবং সে সকল প্রতিবাদকারীদের অনেকেই সেনাসদস্যদের দ্বারা আক্রান্ত ও গুলিবিদ্ধ হয়। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার এই ব্যর্থতার কারণে তার পদ থেকে পদত্যাগ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীকে চট্টগ্রামে নিম্নলিখিত লক্ষ্যসমূহ ঠিক করে দেয়া হয়:

  • ই বি আর সি ইউনিট, ৮ম ই বি আর, ই পি আর এবং পুলিশ বাহিনীকে নীরস্ত্র করা।
  • পুলিশের অস্ত্রসস্ত্র, রেডিও স্টেশন এবং টেলিফোন এক্সচেইঞ্জ দখল করে নেয়া।
  • পাকিস্তানি নৌবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করা।
  • লে কর্নেল এম আর চৌধুরী এবং আওয়ামি লীগ নেতৃবৃন্দদের গ্রেফতার করা।

২৬ মার্চে কুমিল্লা থেকে আগত ৫৩তম ব্রিগেড ট্রুপসের দ্বারা চট্টগ্রাম গ্যারিসনের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়।

1 thought on “অপারেশন সার্চলাইট”

Leave a Comment

error: Content is protected !!