করোনা-পরবর্তী শারীরিক সমস্যা

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও যখন করোনার চিকিত্সা ও ব্যবস্থাপনায় মোটামুটি দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণের দিকে এগিয়ে চলছে, ঠিক তখনই সারা পৃথিবীব্যাপী প্রথম ঢেউ, এরপর শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বা তৃতীয় ঢেউয়ের ধাক্কা। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে আবারও শুরু হয়েছে এই ভাইরাসটির তাণ্ডবলীলা।

পাশাপাশি করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার, প্রাপ্তি ও প্রয়োগ নিয়ে সারা পৃথিবীতে চলছে নানা উদ্যোগ, তোড়জোড় আর প্রতিযোগিতা। অনেক দেশেই ইতিমধ্যে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে। গবেষণাগার থেকে জনগণের মধ্যে ভ্যাকসিন সহজলভ্য করার প্রয়াসে ব্যস্ত প্রতিটি রাষ্ট্র। এত কিছুর মধ্যেও স্বস্তির জায়গা হচ্ছে, করোনা আক্রান্ত রোগীর প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি সুস্থ হয়ে উঠছেন।

তবে সুস্থ হয়ে ওঠার পরও কিছু কিছু রোগীদের মধ্যে নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কোভিড-পরবর্তী জটিলতা। করোনা যেন পিছু ছাড়ছে না, আক্রান্ত রোগীদের অনেকেরই শরীর থেকে ভাইরাস চলে যাওয়া বা নেগেটিভ হওয়ার পরেও ধ্বংসের রেশ কিন্তু রয়ে যাচ্ছে অথবা নতুন করে কিছু কিছু উপসর্গ বা দীর্ঘমেয়াদে ধারাবাহিক নানারকম জটিলতায় ভুগতে হচ্ছে।

রোগীর শরীরের এমন কোনো অঙ্গ নেই যেখানে করোনা ভাইরাস তার ধ্বংসলীলা চালায় না। ভাইরাসটি ফুসফুসসহ রোগীর হার্ট, কিডনি, লিভার, রক্ত সংবহনতন্ত্র এবং স্নায়ুতন্ত্রকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই সুস্থ হওয়ার পরও বা করোনা নেগেটিভ হওয়া বা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া মানেই সব ভোগান্তির অবসান নয়। সুতরাং করোনা থেকে মুক্ত হওয়ার পরও চাই বাড়তি সতর্কতা এবং নিয়মিত চিকিত্সকের তত্ত্বাবধায়নে থাকা। নিম্নে করোনা-পরবর্তী সম্ভাব্য জটিলতাগুলো তুলে ধরা হলো।

১) পোস্টভাইরাল এসথেনিয়া বা পোস্টভাইরাল ফ্যাটিগ সিনড্রোম: শুধু করোনা নয়, যে কোনো ভাইরাসজনিত রোগের পর শারীরিকভাবে প্রচণ্ড দুর্বল লাগা, অবসাদ বা ক্লান্তি বোধ হওয়া, মাথাঘোরা, মাথাব্যথা, শরীর ম্যাজ ম্যাজ করা, হাত-পা অবশ অবশ ভাব, ঝিঁঝিঁ লাগা, মাংসপেশি, হাড় বা অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, কোমরে ও মেরুদণ্ডে ব্যথা, অরুচি, অস্থিরতার মতো কিছু লক্ষণ দেখা যায়।

একে বলে পোস্টভাইরাল এসথেনিয়া। করোনা-পরবর্তী সময়ে এক-তৃতীয়াংশ রোগীরা এই সমস্যায় ভোগেন।

২) শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা: করোনা ভাইরাস সর্বপ্রথম মানবদেহের শ্বাসতন্ত্রে আক্রমণ করে এবং সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে ফুসফুসের। ফলে শ্বাসকষ্ট হয় এবং অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। সংক্রমণ তীব্র হলে অনেকের ভেন্টিলেটর সাপোর্টেরও প্রয়োজন পড়ে। করোনাকালীন শুরু হওয়া শ্বাসকষ্ট ও কাশি হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরও মাঝেমধ্যে হতে পারে। ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে ফুসফুসের যে ক্ষতি হয়, তাতে শরীরের অক্সিজেন গ্রহণের ক্ষমতা কমে যায়। এই ক্ষমতা পুরোপুরি ফিরে আসতে বেশ সময় লাগে। তাই দেখা যায়, সামান্য পরিশ্রমে বা হাঁটাচলা করতে অনেকে হাঁপিয়ে উঠতে পারেন। বিশেষ করে যাদের সংক্রমণ তীব্র ছিল, যারা আইসিইউতে থেকেছেন, তাদের শ্বাসক্রিয়া আবার স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগে। করোনা ভাইরাস ফুসফুসের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত তৈরি করতে পারে।

৩) স্বাদ ও ঘ্রাণ ক্ষমতা কমে যাওয়া: করোনা রোগীদের খাবারে অরুচি এবং ঘ্রাণ না পাওয়ার সমস্যা থেকে যায় বেশ কিছুদিন। যারা আইসিইউতে ভেন্টিলেটরে ছিলেন, তাদের অনেকের খেতে এবং গিলতে সমস্যা হতে পারে। কারো কারো গলায় কিছু আটকে আছে কিংবা খাবার আটকে যাচ্ছে বলে মনে হয়। অনেকের কণ্ঠস্বরেও সমস্যা হতে পারে, কণ্ঠ ফ্যাসফেসে হয়ে যাওয়া, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া তাদের মধ্যে অন্যতম।

৪) হূদেরাগের সমস্যা: আগে থেকে হূদেরাগ থাকা রোগীদের করোনা সংক্রমণ হলে তাদের রোগের তীব্রতা বা মৃত্যুঝুঁকি বেশি থাকে। তবে আগে থেকে হূদেরাগ না থাকলেও অনেকের করোনা-পরবর্তী সময়ে নতুন করে হূদ্যন্ত্রের জটিলতা দেখা দিতে পারে।

৫) স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা: অনেক সময় করোনা আক্রান্ত রোগীরা মাথাঘোরা, তীব্র মাথাব্যথা, সাময়িক ও দীর্ঘমেয়াদি স্মৃতিভ্রম বা ভুলে যাওয়ার প্রবণতার মতো সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এমনকি মস্তিষ্কের ধমনিতে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে ব্রেইন স্ট্রোকের ঘটনাও ঘটছে। এসব রোগের ফলে অজ্ঞান হওয়া, শরীরে বিভিন্ন অঙ্গের দুর্বলতা বা প্যারালাইসিস, ভারসাম্য রক্ষায় সমস্যা, স্পর্শ বা অনুভূতি বোধের সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে।

৬) রক্ত জমাট বাঁধা ও রক্তনালির বিভিন্ন সমস্যা: শরীরের বিভিন্ন রক্তনালিতে রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা করোনা আক্রান্ত রোগীর প্রধান একটি জটিলতা। রক্তনালির মধ্যে রক্ত জমাট বাঁধার ফলে সংশ্লিষ্ট রক্তনালি দ্বারা সরবরাহকৃত অঙ্গ যেমন : ফুসফুস, হার্ট, ব্রেন, কিডনি, হাতের বা পায়ের গভীর রক্তনালি ইত্যাদির ক্ষতি হতে পারে।

৭) কিডনি ও লিভারের সমস্যা: বিশেষত যারা আগে থেকেই কিডনি, লিভারের বিভিন্ন রোগে ভোগেন, তাদের অনেকের করোনা সংক্রমণের ফলে কিডনি বা লিভারের ওপর সাময়িক বা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ায় এসব অঙ্গ অকার্য হয়ে যেতে পারে। তাই রোগ-পরবর্তী সময়ে লিভার বা কিডনি রোগীদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

৮) ডায়াবেটিস: যারা আগেই ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগে আক্রান্ত ছিলেন, দেখা যায় করোনা-পরবর্তী সময়ে তাদের রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। আবার দেখা যায়, আগে ডায়াবেটিস ছিল না কিন্তু করোনাকালীন ব্যবহূত ওষুধ (যেমন স্টেরয়েড) বা ভাইরাসের প্রভাবে পরবর্তী সময়ে তাদের নতুন করে ডায়াবেটিস বা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে গেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এটি সাময়িক, কিছুদিন পর এমনিতেই স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে যদি সময়ের সঙ্গে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে না আসে, তবে চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে।

৯) উচ্চ রক্তচাপের নিয়ন্ত্রণহীনতা: উচ্চ রক্তচাপের রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। আবার যাদের উচ্চ রক্তচাপ নেই তারাও করোনা-পরবর্তী সময়ে অনেকেই উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হন। ডায়াবেটিসের মতো এটিও কিছুদিনের মধ্যে নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে দীর্ঘদিন রক্তচাপ অনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকলে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

১০) পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা: করোনা-পরবর্তী সময়ে রোগীদের নানা রকম পেটের সমস্যা দেখা দেয়। যেমন : অ্যাসিডটি বা গ্যাস হওয়া, পাতলা পায়খানা হওয়া কিংবা ঘনঘন পায়খানা হওয়া, বদহজম ইত্যাদি। তবে করোনা-পরবর্তী সময়ে খাবারের প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখলে দ্রুত এসব সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যেতে পারে।

১১) মানসিক সমস্যা: করোনা-পরবর্তী সময়ে নানা রকমের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক রোগী বলেন, তাদের কিছুই ভালো লাগে না, কিছু করতে ইচ্ছা করে না, অনেকের প্যানিক ভাবটা থাকে। হঠাত্ করে মনে হয়—শ্বাস বা দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া বিষণ্নতা, মানসিক অস্থিরতা, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, খিটখিটে মেজাজ, রুক্ষ আচার-আচরণ, কাজে মনোযোগের অভাব, উত্তেজনা, স্মৃতিভ্রম, বুক ধড়ফড় করা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়।

১২) ঘুমের সমস্যা: করোনা আক্রান্ত রোগীর ফুসফুসে কিংবা মস্তিষ্কসহ শরীরবৃত্তীয় কিছু পরিবর্তন হয়, যার ফলে রোগীর ঘুমের ওপর সাময়িক বা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। সহজে ঘুম আসে না বা বারবার ঘুম ভেঙে যায়। অনেকে ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্নও দেখেন। এছাড়া মানসিক চাপ বা টেনশনের কারণেও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। আবার স্বাভাবিক ঘুমের অভাবে শারীরিক ও মানসিক সমস্যাগুলো আরো বেড়ে যায়।

করোনা-পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদি জটিলতাগুলো কমাতে করণীয়:

১) পরিমিত সুষম এবং পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় টাটকা শাকসবজি এবং ফলমূল যোগ করুন। প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল জাতীয় খাবার খান। অনেকের খাবার গিলতে সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে প্রথমে নরম ভাত, বেশি করে সেদ্ধ করা নরম খাবার দিয়ে খাদ্যাভ্যাস শুরু করুন।

২) এ সময়ে অনেকের মুখে ঘা হতে পারে। এর জন্য চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ ব্যবহার করুন। নিয়মিত হালকা গরম পানিতে লবণ দিয়ে গড়গড়া এবং কুলকুচি করলে আরাম পাবেন। পাশাপাশি নিয়মিত দাঁত এবং জিহ্বা পরিষ্কার করুন।

৩) যারা আগে শারীরিক পরিশ্রম বা নিয়মিত ব্যায়াম করতেন তাদের সতর্ক হতে হবে। করোনা থেকে সেরে উঠেই শারীরিক পরিশ্রম, ব্যায়াম বা হাঁটাচলা শুরু করবেন না। কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে অল্প পরিশ্রমের কাজ বা হাঁটাচলা দিয়ে আবার শারীরিক পরিশ্রম শুরু করা যেতে পারে।

৪) করোনা থেকে সেরে উঠেই পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু করতে পারবেন, এমনটি আশা করা ঠিক নয়। হসপিটাল থেকে ফেরার পর কিছুদিন পূর্ণ বিশ্রামে থাকা ভালো। প্রথমেই বেশি পরিশ্রমের কাজ করবেন না। ধীরে ধীরে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করুন এবং সহ্যক্ষমতা অনুযায়ী কাজের পরিধি বাড়ান।

৫) নিয়মিত সাত-আট ঘণ্টা ঘুমানোর চেষ্টা করুন, ক্লান্তি লাগলে বিশ্রাম নিন। ধূমপান বন্ধ করুন। সন্ধ্যার পর চা ও কফি পরিহার করুন। ঘুমের অসুবিধা হলে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী ঘুমের ওষুধ সেবন করা যেতে পারে।

৬) করোনা সংক্রমণপরবর্তী ফুসফুসের জটিলতার জন্য দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্ট ও কাশি থাকতে পারে। চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওষুধ সেবন করুন, প্রয়োজনে ইনহেলার ব্যবহার করতে পারেন, বাড়িতে পজিশনিং আর ব্রিদিং এক্সারসাইজ করতে হবে। এরপরও বেশি শ্বাসকষ্ট বেশি হলে চিকিত্সকের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

৭) মানসিক সমস্যা সমাধানে মন প্রফুল্ল রাখতে চেষ্টা করুন। গান শোনা, বই পড়া বা মনকে প্রফুল্ল করে এমন কিছু করুন। ধীরে ধীরে নিজের পছন্দের কাজ বা শখগুলো শুরু করুন। বন্ধুবান্ধব ও আপনজনদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। পরিবার ও সমাজের অন্যদের উচিত হবে—এসব রোগীদের পাশে থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। তবে বেশি মানসিক অশান্তিতে ভুগলে চিকিত্সকের শরণাপন্ন হতে পারেন।

মনে রাখতে হবে, খুব কম সংখ্যক রোগীর করোনা-পরবর্তী এসব জটিলতা দেখা দেয়, যেগুলোর অধিকাংশই সাময়িক। তাই অযথা ভয় পাওয়ার বা আতঙ্কিত হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তবে সতর্ক থাকতে হবে, নিজের কিংবা অন্য কারো এই ধরনের জটিলতা দেখা দিলে, খুব দ্রুত চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই করোনা মহামারির পর পৃথিবীব্যাপী স্বাস্থ্যবিষয়ক আচার-আচরণ, ধ্যানধারণা এবং জ্ঞানের পরিবর্তন হবে। তবে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হলো, সব কিছুর আগে আমাদের দেহঘড়ির সুস্থতা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলার ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া।

লেখক: ইউজিসি অধ্যাপক ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিতসক।

Leave a Comment

error: Content is protected !!