তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশন: প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার। সম্প্রতি সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আবার আলোচনায় এসেছে তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশন গঠন। শুরু হয়েছে সরকার এবং বিরোধী দলীয় নেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তব্য।

জাতীয় নির্বাচনের সময় অনেকটা দূরে হলেও ঘনিয়ে এসেছে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারিতে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় দরকার হবে নতুন কমিশন এবং গঠিত নতুন কমিশনের অধীনেই হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। যদিও এখন তিনমাস বাকী রয়েছে তারপরও পরবর্তী কার্যক্রম নিয়ে সরগরম রাজনৈতিক অঙ্গন। নতুন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে কিছু কার্যক্রমও শুরু হওয়ার আভাস পাওয়া গেছে। সংবিধানের ক্ষমতা অনুযায়ি এ কমিশন গঠনের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির।

ইতোমধ্যে দুবার সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে। কমিশন গঠনের সময় থেকে বিরোধী পক্ষের অভিযোগ রয়েছে যা আবার সরকারি দল অস্বীকার করেছে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন বিশিষ্ট জনেরাও এ বিষয়ে সরগরম হয়েছে। যদিও এসব বিষয় আমলে নিচ্ছে না সরকারি দল।

সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘ প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চার জন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোনো আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ করিবেন।’ কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের এত বছর পরও এ বিষয়ের উপর কোন দলই আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। উদ্যোগ গ্রহণের কোন প্রয়োজনীয়তা উপলদ্ধি করে বলে মনে হয় নাই। যখন যে দলই সরকার থাকে সে দলই নির্বাচন কমিশন ইচ্ছা মাফিক গঠন করতে চায়। আর দোহাই দেওয়া হয় সংবিধানের। কোন কোন বিশিষ্ট জন আবার আইন প্রণয়ন না করে নির্বাচন কমিশন গঠন করাকে সংবিধান পরিপন্থী বলছেন।

সবচেয়ে বড় কথা হলো সাধারণ জনগণ সংবিধান বা আইন সম্পর্কে তেমন কোন ধারণা নেই তারা কেবল তাদের ভোটটা স্বাভাবিকভাবে দিতে চায়। রাজনৈতিক দলের লোকজনও চায় তবে কেবল বিরোধী দলে থাকা অবস্থায়। কারন সরকারী দলের ভাষ্য হচ্ছে দেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা রয়েছে এবং এসব কমিশনের অধীনেই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব । বাংলাদেশের রাজনীতিতে পজেটিভ নেগেটিভ বৈচিত্রটা অনেক বেশি বলেই মনে হয়।

তত্ত্বাবধায় সরকারের প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু কথা বলা জরুরি না হলে এবিষয়ে আলোচনাটাই পূর্ণাঙ্গতা পাবে বলে মনে হয় না। তত্ত্বাবধায় সরকার বাংলাদেশের বিলুপ্ত একধরণের শাসন ব্যবস্থা যা ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট বাতিল বলে রায় দেন। এ ব্যবস্থাটি হলো দুটি নির্বাচিত সরকারের মধ্যবর্তী সময়কালে সাময়িকভাবে অনির্বাচিত ব্যক্তিগণ দেশের শাসনভার গ্রহণ করবেন তবে নির্বাচন পরিচালনাই তাদের মূখ্য কাজ হিসেবে গণ্য হবে। গণতন্ত্রের দাবীতে এরশাদ সরকারের আমলে ব্যাপক সংগ্রাম চলতে থাকে। চলমান আন্দোলনে সরকারী দল ছাড়া প্রায় সব দলই এ দাবীর পক্ষে অবস্থান নেয়।

১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকারের পতন ঘটে। ঐক্যমতের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসে এখানেও আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অস্বচ্ছতার অভিযোগ আনে। এ নির্বাচনের পর সংসদ গঠন থেকেই এ ব্যবস্থা সংবিধানে অর্ন্তভূক্ত করার জন্য বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে চাপ আসতে থাকে।

১৯৯৩ সালে আওয়ামীলীগ ও জামায়াত এ সংক্রান্ত একটি বিল সচিবালয়ে পেশ করে ১৯৯৪ সালের ২৭ জুন এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে রুপরেখা ঘোষণা করে। তখনকার সরকার প্রধানও একে সংবিধান বিরোধী এবং অপ্রয়োজনীয় বলে উল্লেখ করে এবং সকল সমঝোতা প্রক্রিয়া ব্যর্থ হয়। শুরু হয় হরতাল অবরোধ জাতীয় সংসদ থেকে সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ ব্যর্থ হয় সমঝোতা প্রক্রিয়া। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে রাষ্ট্রপতি ভেঙ্গে দেয় জাতীয় সংসদ।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় বিরোধীদল বিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচন এখানেও দেখা দেয় ব্যাপক সহিংসতা । ২১ মার্চ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিল জাতীয় সংসদে উত্থাপন হয় এর মধ্যে ২৩ মার্চ চাকুরির বিধি ভঙ্গ করে সরকারি চাকুরিজীবীরা আন্দোলনের নামে তৈরি করে জনতার মঞ্চ। পরে ব্যাপক চাপের মুখে জাতীয় সংসদে ২৬ মার্চ পাস হয় এ বিল।

এয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে নির্দলীয় সরকারের এ বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত করা হয়। বিভিন্ন সময়ে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ, বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিচারপতি লতিফুর রহমান, অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ ও ড. ফখরুদ্দিন আহম্মেদ প্রধান উপদেষ্ঠার দায়িত্ব পালন করে দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেন যদিও পরাজিত দলের নিকট তা সমাদৃত হয়নি এমনকি নির্বাচনে কারচুপির বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে।

২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এব্যবস্থাটিকে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে । সরকারি দলের নিকট চাহিদা শেষ অন্যদিকে বিরোধী দলের নিকট বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ১৯৭২ সালের ৭ জুলাই প্রতিষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের উপর রাষ্ট্রে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য দায়িত্ব রয়েছে ।

সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদের আওতায় নির্বাচন কমিশন স্থাপতি হয়েছে ১১৯ অনুচ্ছেদে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে বলা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ নির্বাচনসহ আনুষাঙ্গিক কার্যাবলি সম্পাদনে স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করবে এবং এতে সকলের সহায়তা করা কর্তব্য। সরকার ও নির্বাচন কমিশন মিলে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করার কথা। যদিও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের জায়গায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার কোন ভাবেই কাম্য হতে পারে না কিন্তু এক দলের প্রতি অন্য দলের অনাস্থা এবং জনগণের রায় না থাকলেও ক্ষমতায় যাওয়ার ইচ্চা নির্বাচন ব্যবস্থাকে জটিল করেছে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাজনৈতিক মাঠ একেবারে গরম হয়ে উঠেছে। বর্তমান নির্বাচন গঠন প্রক্রিয়ায় আস্থা রয়েছে সরকারের এবং বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলের রয়েছে চরম বিরোধিতা। মোট কথা হলো একটি দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে প্রয়োজন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সকল রাজনৈতিক দলই এটা বুঝে তবে বিরোধী দলে থাকা অবস্থায়।

ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ভুলে যায় অন্যের অধিকার। দেশের নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করতে হলে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন প্রয়োজন একথা অস্বীকার করার যেমন কোন সুযোগ নেই তেমনি নির্বাচন কমিশন গঠনের ক্ষেত্রে আলাদা আইন প্রণয়নের কোন বিকল্প নেই। শুধু জাতীয় নির্বাচন নয় সকল ক্ষেত্রেই প্রয়োজন সঠিক গণতন্ত্র ব্যবস্থার প্রয়োগ। এই তত্ত্বাবধায় সরকার ব্যবস্থার কোন প্রয়োগই বিশ্বে দেখা যায় না। এ ধরনের অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে সরকার ব্যবস্থা জনগণের নিকট পূর্বে আস্থা অর্জন করতে পারলেও বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা দীর্ঘদিন থাকায় মানুষের মাঝে তার গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এর পাশাপাশি এদেশের বেশ কয়েকটি নির্বাচন মানুষের মনে বিরুপ প্রভাব ফেলেছে একথা দ্রুব সত্য। এ থেকে উত্তোরণের জন্য একটি সুন্দর নির্বাচন কমিশন গঠনের মাধ্যমে পরবর্তী নির্বাচনগুলো সম্পন্ন করা একান্ত জরুরি।

বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা দ্বাদশ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে। কেবল মাত্র বর্তমান কমিশনই বিতর্কিত হয়েছে একথা বলা যাবে না প্রায় প্রতিটি কমিশন সম্পর্কেই অভিযোগ তুলেছে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতারা। একটি ভালো নির্বাচনের জন্য কেবলমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারই যথেষ্ট নয় প্রয়োজন ভালো মানের একটি নির্বাচন কমিশন।

ভালো মানের নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা মুখে যতই বলা হউক না কেন বাস্তবিক অর্থে সঠিক নির্বাচন কমিশন গঠন এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন ছাড়া সম্ভব নয়। ভালো নির্বাচন কমিশন গঠন এবং আমার জয় লাভের কূট প্রক্রিয়া থেকে সরে এসে দেশের মানুষের মনের ভাবনার প্রতিফলন ঘটিয়ে সুষ্ঠ অবাধ নির্বাচন নির্বাচন প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যাওয়া সব পক্ষেরই দায়িত্ব বলেই মনে হয়। কারন একটি গ্রহণযোগ্য সুন্দর নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে অর্থবহ করে তোলে।

লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী

Leave a Comment

error: Content is protected !!