বন্ধ পাটকল পাহারায় ৫০০ কোটি টাকা

বন্ধ পাটকল পাহারায় ৫০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন। বাংলাদেশ সচিবালয়ে প্রায়ই দেখা মেলে লতিফ বাওয়ানী জুট মিলস লিমিটেডের মাঝারি গোছের এক কর্মকর্তার। ছাত্রাবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা ছিলেন। সেই সুবাদে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনেও (বিজেএমসি) তাঁর পরিচিতি আছে। ঘন ঘন সচিবালয়ে যাতায়াতের কারণ জিজ্ঞেস করতেই হাসিমুখে সহজ-সরল জবাব, ‘ভাই, পাটকল বন্ধ। তেমন কোনো কাজ নেই। বলতে পারেন শুয়ে-বসেই বেতন পাচ্ছি। ঘরে বসে না থেকে পুরোনো ভাই-বেরাদারদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেই সময় কাটছে।’

বিজেএমসির এমন ২ হাজার ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী ৪২ মাস ধরে কাজ না করেই বেতন-ভাতা নিচ্ছেন। কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রতিষ্ঠানটির প্রধান কার্যালয়সহ বন্ধ পাটকলগুলোর সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করলেও বেশির ভাগই ব্যক্তিগত বা পারিবারিক কাজে ব্যস্ত। যদিও এ কথা মানতে নারাজ প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়।

তাদের দাবি, যাঁরা এখনো বিজেএমসিতে কর্মরত আছেন, তাঁরা সবাই বন্ধ পাটকল ও এর সম্পদ পাহারা দিচ্ছেন। এ জন্য প্রতি মাসে তাঁদের বেতন-ভাতা খাতে বিজেএমসির নিজস্ব তহবিল থেকে ১২ কোটি টাকা দিতে হচ্ছে। সে হিসাবে এই খাতে ৪২ মাসে প্রতিষ্ঠানটির ব্যয় হয়েছে ৫০০ কোটি টাকার বেশি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবদুর রউফ বলেন, বিজেএমসিতে কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী আগেও ফাঁকিবাজি করতেন, এখনো তা-ই করছেন। তবে সবাই এক রকম নয়। প্রধান কার্যালয়সহ বিভিন্ন পাটকলের সম্পদ পাহারা দিচ্ছেন তাঁরা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্তীকরণের জন্য আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে কমিটি আছে। তাদের সুপারিশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে আরও একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা আত্তীকরণ নিয়ে কাজ করছে। জাতীয় নির্বাচনের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। এর আগপর্যন্ত বিজেএমসির জনবলকে বেতন-ভাতা দিতেই হবে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, বন্ধ ঘোষিত ২৫টি পাটকলের ২ হাজার ৫৬৮ জনবলের মধ্যে ৯০০ জনকে বিভিন্ন করপোরেশনে আত্তীকরণের পদ্ধতি ও সুপারিশের জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। পরে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে ‘সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী আত্তীকরণ আইন, ২০২৩’-এর খসড়া তৈরি করা হয়। খসড়াটি অনুমোদনের জন্য গত ১৩ মার্চ মন্ত্রিসভার বৈঠকে উপস্থাপন করা হয়।

প্রস্তাবিত আইনটি সরকারি চাকরি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না, তা যাচাই করতে আইনমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই সভায় খসড়া আইনটি পর্যালোচনা করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের আরও একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি আত্তীকরণ আইন নিয়ে কাজ করছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। ওই কমিটির প্রতিবেদনের পরই মূলত সংশ্লিষ্ট আত্তীকরণ আইন মন্ত্রিসভায় তোলা হবে। মন্ত্রিসভার অনুমোদন সাপেক্ষে এটি কার্যকর হবে।

বিজেএমসির মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও সা. সেবা) মো. নাসিমুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে বিজেএমসিতে কর্মরত আছেন ২ হাজার ৪০০ কর্মকর্তা-কর্মচারী। পাটকল বন্ধ থাকলেও তাঁরা কাজ করছেন। পাটকলগুলোর মেশিনসহ সম্পদ পাহারা দিচ্ছেন। সাড়ে তিন বছর ধরেই তাঁরা বিজেএমসির সম্পদ পাহারা দিচ্ছেন। প্রতি মাসে তাদের বেতন-ভাতা খাতে নিজস্ব তহবিল থেকে ১২ কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে।

বিজেএমসি সূত্রে জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে বিজেএমসির লোকসান ছিল ২৬০ কোটি টাকার বেশি। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, সম্পত্তি মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি-বিদ্যুৎ, অপচয় ইত্যাদি খাতে এই লোকসান হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ ব্যয় হয়েছে ১৪০ কোটি টাকার ওপরে। ২০২০-২১ অর্থবছরেও বিজেএমসির লোকসান হয়েছিল প্রায় ৩৭৩ কোটি টাকা। বর্তমানে ২৫টি পাটকলের মধ্যে ১৬টিই বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়া আছে। এর মধ্যে কয়েকটি পাটকল চালু হয়েছে। বাকিগুলোর কোনোটি নিয়ে মামলা চলছে, আবার কোনোটির ইজারা প্রক্রিয়াধীন।

জানা গেছে, পাট ও টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদন করার শর্তে বিজেএমসি পাটকল ইজারা দিলেও যারা ইজারা নিয়েছে, তাদের বেশির ভাগই পাট ব্যবসায়ী নয়। সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিল ইজারা নিয়েছে রশিদ অটোমেটিক রাইস মিলস। খুলনার প্লাটিনাম জুবিলি জুট মিলস ইজারা নিয়েছে ফরচুন সুজ লিমিটেড। নরসিংদীর বাংলাদেশ জুট মিলস ইজারা নিয়েছে বে ফুটওয়্যার।

বাংলাদেশ পাটকল শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাহবুবুল আলম অভিযোগ করেন, অনেক বন্ধ পাটকলে খামার বানিয়ে মুনাফা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আত্তীকরণ করতে আইন হয়নি গত সাড়ে তিন বছরেও। এই সুযোগে প্রতিষ্ঠানটির এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী বন্ধ পাটকলের মেশিন খুলে বিক্রি করে দিচ্ছে। গরু-মহিষের খামার বানিয়েও ব্যবসা করছেন অনেকে। কাজ না করেও পদোন্নতি-পদায়ন সবই পাচ্ছেন তাঁরা। বিজেএমসির সম্পদ এখন লুটের মালে পরিণত হয়েছে।’

Leave a Comment

error: Content is protected !!