বিজয়ের প্রেরণা লালন করতে হবে-গোপাল অধিকারী

বিজয়ের প্রেরণা লালন করতে হবে। বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে লাল-সবুজে আঁকানো একটি দেশের নাম। আর বাংলাদেশ আমার কাছে অশ্রুসিক্ত মায়ের অক্ষিকোঠরে জমে থাকা ভালোবাসার নাম। বাংলাদেশ আমার কাছে গর্বের নাম। বাংলাদেশ আমার কাছে স্বাধীনভাবে চলা একটি মাতৃভূমির নাম।

ডিসেম্বর মাস। বাংলাদেশ তথা বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক মাস। ডিসেম্বর আমাদের আনন্দ ও বেদনার মাস। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে আমরা অনুভব করি ডিসেম্বর কেন বেদনার ছিল, কেনই বা অনুপ্রেরণার হলো? বিজয়ের কথা যখন অনুভব করি তখন আমরা আনন্দে আত্মহারা হই। আলিঙ্গন করি আনন্দের সঙ্গে। আমরা দেখতে পাই আমাদের জাতির জীবনে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোর মধ্যে অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস ডিসেম্বর। কারণ এই মাসেই অর্জিত হয়েছে কাঙ্ক্ষিত বিজয়।

১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বোচ্চ অর্জনের ও আত্মগৌরবের একটি দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি বিজয় ছিনিয়ে আনে।

বাঙালি জাতির ইতিহাস হাজার বছরের পরাধীনতার ইতিহাস। আর এই পরাজয়ের ইতিহাসই এনে দেয় বিজয়ের পথ। তাই ইতিহাসকে জানতে হবে, জানাতে হবে নতুন প্রজন্মকে। বিজয়ের প্রেরণা লালন করতে হবে সবার। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ স্বাধীন হলেও এই ভূখ-ের বাঙালির স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আসেনি। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয় এবং পূর্ববাংলাকে নিয়ে পাকিস্তান নামে একটি অসম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালির ওপর চেপে বসে এবং শাসন, শোষণ ও নির্যাতনের স্টিমরোলার চালায়। শুধু ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র গঠন হলেও হয়নি ভাগ্যের উন্নয়ন।

বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিকে মুক্তির আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পথে এগিয়ে নিয়ে যান। ’৫২-এর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ, ’৫৬-এর সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন, ’৫৮-এর মার্শাল ল’বিরোধী আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার আন্দোলন, ৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থান, ৬ দফাভিত্তিক ’৭০-এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে অবধারিত করে তোলে। এসব আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চৌকস নেতৃত্বেই কাল হলো বঙ্গবন্ধুর। ছক করা হলো তাকে দাবিয়ে দেওয়ার।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বাঙালি জাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। এরই প্রেক্ষাপটে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানে নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতিতেই তাকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত বাংলাদেশের সরকারের অধীনে পরিচালিত দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে। এই বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের।

আত্মসমর্পণ নিয়ে আলোচনায় সাব্যস্ত হয়, ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হলেও নিয়াজি ও তার বাহিনী তখনই অস্ত্র সমর্পণ করবে না। জেনারেল জ্যাকব ১৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের অস্ত্র রাখার অনুমতি দেন। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী যুদ্ধবন্দি হলেও ঢাকা সেনানিবাসে তাদের অবস্থান ছিল সশস্ত্র। এ এক অ™ু¢ত পরিস্থিতি। তিন দিন পর ১৯ ডিসেম্বর ঢাকা সেনানিবাসের গলফ মাঠে অস্ত্র সমর্পণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩০ হাজার সৈন্য। তাদের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। মিত্রবাহিনীর পক্ষে ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল জগৎ সিং অস্ত্র গ্রহণ করেন। বাঙালির এই মুক্তিযুদ্ধে পাশে দাঁড়ায় প্রতিবেশী দেশ ভারত, সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সরকার ও মুক্তিকামী মানুষ। তবে কোনো কোনো পরাশক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরুদ্ধে নামে এবং পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়।

শত প্রতিকূলতা পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধে দোর্দ- গতিতে এগিয়ে যায় বাঙালি। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান আর দুই লাখ মা-বোনের ত্যাগ-তিতিক্ষায় এই বিজয় অর্জিত হয়। কোটি বাঙালির আত্মনিবেদন ও গৌরবগাথা গণবীরত্বে পরাধীনতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পায় বাঙালি জাতি। পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। প্রতিবছর বাংলাদেশে দিবসটি যথাযথ ভাবগাম্ভীর্য এবং বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে পালিত হয়। ১৬ ডিসেম্বর ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসের সূচনা ঘটে।

আমরা যারা জন্ম থেকেই বাংলাদেশকে জানি বা চিনি বা বাংলাদেশ নামটি গর্বের সঙ্গে বলি বা গর্ব করি সেই বাংলাদেশ কিন্তু সংগ্রামেরই ফসল। বাংলাদেশ কিন্তু এমনিতেই হয়নি। একটি সন্তানকে তিল তিল করে বড় করতে একটি পরিবারকে কতটা কষ্ট করতে হয় তা কিন্তু সেই সময় ছাড়া বোঝা যায় না। ঠিক তেমনি আজকের বাংলাদেশ স্বীকৃতি নিতে কত যে কষ্ট হয়েছে তা হয়তো সেদিনের সেই বীরপুরুষরা ছাড়া আমরা বেশি বুঝতে পারব না। কিন্তু সেদিনে সেই দুর্বিষহ কষ্টের কথা যদি কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তির কাছে শুনি তা ভাবতে গেলে শরীরে শিহরণ দেয়। নেই খাওয়া, নেই কর্ম। সব সময় এক প্রকার আতঙ্ক কখন বুঝি মিলিটারিরা আসে!! কখন যেন গুলি লেগে মারা যায় ছেলে। মায়ের চিন্তা সন্তানকে নিয়ে আর সন্তানের চিন্তা বাবা-মাকে নিয়ে। এই বুঝি কিছু হয়ে যায়? পাকিস্তানিরা আসবে আর পাখির মতো জীবনটা নিয়ে যাবে এমনটাই সত্য ভাবনা ছিল সবার মনে মনে। তাই তো কোনো অসুখ না থাকলেও কেমন যেন আতঙ্ক? ঘুমের মধ্যেই জেগে ওঠে গুলির আতঙ্কে? জেগে ওঠে পাকিস্তানি এসেছে এমন সন্দেহে। তাই তো আজও বিজয়ের দিনে মায়ের চোখে থাকে ছেলেহারা বেদনা। মেয়ের চোখে থাকে পিতা হারানো সেই বেদনা। আর আমরা অনুভব করি দেশের মেধাবীদের হারানোর সেই রিক্ততা। শত বেদনার মাঝে তবুও গেয়ে যাই সাফল্যের গান। আওয়াজ তুলি ‘জয় বাংলা’ বাঁচুক সবার প্রাণ। বিজয় আমাদের প্রেরণা। ডিসেম্বর আমাদের প্রেরণা। আসুন সবাই মিলে সেই প্রেরণা বুকে লালন করি। ছেলেহারা মায়ের শোক লাঘব করতে কাজ করি। পিতৃহারা বোনটির পাশে থাকি। কষ্টের বাংলাদেশকে সোনার বাংলাদেশ গড়তে সাহসী ভূমিকা রাখি।

গোপাল অধিকারী: প্রাবন্ধিক

Leave a Comment

error: Content is protected !!