হলুদ সাংবাদিকতার ইতিহাস

জোসেফ পুলিৎজারকে বলা হয় গ্র্যান্ডফাদার অব দ্য জার্নালিস্ট। শুধু তাই নয়, সর্বকালের সেরা সাংবাদিক বলে মানা হয়। অনুসন্ধানী ও সৃজনশীল সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে তিনি কিংবদন্তি।

জোসেফ পুলিৎজার ‘সেন্ট লুইস পোস্ট ডিসপ্যাচ’ এবং নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের প্রকাশক ও এ পত্রিকার মাধ্যমে নতুন এক ধরনের সাংবাদিকতার সূচনা করেন। হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভূত খ্যাতনামা আমেরিকান সাংবাদিক জোসেফ পুলিৎজার জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৭ সালের ১০ এপ্রিল।

অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ থেকে ঊনবিংশ শতকের সূচনালগ্ন পর্যন্ত তিনি ছিলেন একাধারে সফলতম লেখক ও সংবাদপত্র প্রকাশক। অর্জিত বিপুল অঙ্কের অর্থ কলম্বিয়া স্কুল অব জার্নালিজম যা বর্তমানে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদান করেন। ১৯১১ সালের ২৯ অক্টোবর মৃত্যুর পর তার ইচ্ছানুসারে ও সম্মানার্থে পুলিৎজার পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়।

সাংবাদিকতা ও আলোকচিত্রকলার পাশাপাশি নাটক, কবিতা, ইতিহাস, পত্র, সংগীতের মতো ২১টি বিভাগে এ পুরস্কার সাংবার্ষিক আকারে প্রদান করা হয়। জন্মকালে তার নাম ছিল পুলিৎজার জোসেফ। ১৮৮০-এর দশকে পুলিৎজার নতুন সাংবাদিকতার কলা-কৌশল প্রবর্তন করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন।

সংবাদপত্র জগতে ইয়েলো জার্নালিজম শব্দটি এসেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে। ইয়েলো জার্নালিজমের একটি মজার ইতিহাস রয়েছে। সেই সময়ের দুই বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিকের নাম জড়িয়ে আছে এ ইতিহাসের সঙ্গে। জোসেফ পুলিৎজার এবং উইলিয়াম র‌্যানডল্ফ হার্স্ট লিপ্ত হন এক অশুভ প্রতিযোগিতায়।

জোসেফ পুলিৎজার একটি পত্রিকা ক্রয় করলেন ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে। পত্রিকাটির নাম নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড। ওই পত্রিকাটির মালিক ছিলেন জে গোল্ড। ক্রমাগত লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে তিনি পত্রিকাটি জোসেফ পুলিৎজারের কাছে বিক্রি করে দেন।

ওদিকে উইলিয়াম হার্স্ট ১৮৮২ সালে ‘দ্য জার্নাল’ নামে একটা পত্রিকা কিনে নেন জোসেফ পুলিৎজারের ভাই অ্যালবার্ট পুলিৎজারের কাছ থেকে। তার পরিবারের সদস্যের পত্রিকা হার্স্টের হাতে চলে যাওয়ার বিষয়টিকে সহজভাবে নিতে পারেননি পুলিৎজার। তার সঙ্গে হার্¯ে¡রও দ্বন্দ্ব শুরু হয়।

পুলিৎজার নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ড ক্রয় করেই ঝুঁকে পড়লেন কিছু কেলেঙ্কারির খবর, চাঞ্চল্যকর খবর, চটকদারি খবর ইত্যাদির দিকে। তিনি একজন কার্টুনিস্টকে চাকরি দিলেন তার কাগজে। তার নাম রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্ট। ওই কার্টুনিস্ট ‘ইয়েলো কিড’ বা ‘হলুদ বালক’ নামে প্রতিদিন নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের প্রথম পাতায় একটি কার্টুন আঁকতেন এবং তার মাধ্যমে সামাজিক অসংগতি থেকে শুরু করে এমন অনেক কিছু বলিয়ে নিতেন, যা একদিকে যেমন চাঞ্চল্যকর হতো, অন্যদিকে তেমনি প্রতিপক্ষকে তির্যকভাবে ঘায়েল করত।

জার্নাল এবং নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের বিরোধ সে সময়কার সংবাদপত্র পাঠক মহলে ব্যাপক আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছিল। এক সময় হার্স্ট পুলিৎজারের কার্টুনিস্ট রিচার্ড ফেন্টো আউটকল্টকে ভাগিয়ে নিলেন তার ‘জার্নাল’ পত্রিকায়। শুধু তাই নয়, মোটা অঙ্কের টাকা-পয়সা দিয়ে পুলিৎজারের নিউইয়র্ক ওয়ার্ল্ডের ভালো সব সাংবাদিককেও টেনে নিলেন নিজের পত্রিকায়। ওদিকে পুলিৎজার তার পত্রিকায় ‘ইয়েলো কিড’ চালাতে শুরু করলেন জর্জ চি লুকস নামে আরেক কার্টুনিস্টকে দিয়ে। লুকসও চালালেন ‘ইয়েলো কিডস’।

দু’জনই পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্য স্ক্যান্ডাল কেলেংকারি চমকপ্রদ ভিত্তিহীন খবর ছাপা শুরু করলেন প্রতিযোগিতামূলকভাবে। এতে মানগত দিক থেকে দুটি পত্রিকাই ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকল। এর ফলে একটা নষ্ট পাঠক গোষ্ঠী গড়ে উঠল, যারা সব সময় স্ক্যান্ডাল বা কেলেঙ্কারি, চটকদারি, ভিত্তিহীন চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী সংবাদ প্রত্যাশা করত। এভাবেই জোসেফ পুলিৎজার এবং উইলিয়াম হার্স্ট দু’জনেই হলুদ সাংবাদিকতার দায়ে অভিযুক্ত এবং ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে রইলেন।

Leave a Comment

error: Content is protected !!