ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সহিংসতা নিরসনে জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা জরুরি

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সহিংসতা নিরসনে জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা জরুরি: গত এপ্রিলে রমজানের শুরুতেই গাজায় আবারো ফিলিস্তিন-ইসরায়েল উত্তেজনা শুরু হয়। ২০ রোজা থেকে ফিলিস্তিনের উপর উপর্যুপরি বিমান ও রকেট হামলায় ব্যাপক প্রাণহানি ও ধ্বংসযজ্ঞের অবতারণা করা হয়। অপরদিকে, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসও রকেট ছুঁড়ে আক্রমণ চালায় তেল আবিবের ওপর। হামলা পাল্টা হামলায় শান্তিকামি জনসাধারণের ব্যাপক প্রাণহানি হয়েছে।

ক্ষমতার রাজনীতি ও বিশ্ব মোড়লদের নানা প্রেক্ষিত থাকলেও শেষ পর্যন্ত জীবন দিতে হয় শান্তিকামী নারী, শিশু ও সাধারণ মানুষকে। প্রতিদিন যুদ্ধাবস্থা দেখে পৃথিবীর সকল শান্তিপ্রিয় মানুষের মধ্যেই অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই এ যুদ্ধাবস্থার সূত্রপাত। তবে সম্প্রতি সময়ে যে যুদ্ধাবস্থা তাতে মনে হয়েছে, ২০১৪ সালের পর এটাই দু’পক্ষের মধ্যে সবচেয়ে তীব্র গোলাগুলি বিনিময়ের ঘটনা। গত কয়েক দিন হলো অবস্থা কিছুটা থমথমে।

তবে এ অবস্থা কতোদিন স্থায়ী হয় সেটাই দেখার বিষয়। এ ঘটনায় জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গভীরভাবে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন। মহাসচিব গুতেরেস ‘শান্তি পুনরুদ্ধারের জন্য প্রয়াস দ্বিগুণ করার’ আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত টোর ওয়েন্সল্যান্ড দু’পক্ষেই পরিস্থিতি পূর্ণমাত্রার যুদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দুইপক্ষকেই উত্তেজনা হ্রাস করার আহ্বান জানিয়েছে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত বন্ধে মার্কিনীদের মধ্যস্থতাতে সততার অভাব ছিল বলে এই সমস্যাটার কোনো স্থায়ী সমাধান সম্ভব হয়নি বলে মনে করেন অনেক কূটনীতিক বিশ্লেষক। যদিও সংঘাতের শুরু থেকে অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল থেকে এ সমস্যা সমাধানের বিষয়ে তারা লেগে আছে। একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, মার্কিন সরকারগুলো বরং ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্বই বিপন্ন করে ফেলেছে। ইরাকের আর লিবিয়ার আজকের অবস্থার জন্য শতাংশে মার্কিনীরাই দায়ী। তা করা হয়েছে ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য। আজকের এ সময়েও ইরানকে পঙ্গু করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র।

মিশরের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে সরিয়ে তার জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল সিসিকে প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে একই কারণে। যুক্তরাষ্ট্রের কলকাঠিতে ইসরায়েলের সঙ্গে ১৩ আগস্ট ২০২০ সংযুক্ত আরব আমিরাত, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২০ বাহরাইনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক করেছে। অলিখিত সম্পর্ক হয়েছে সৌদি আরবের সঙ্গেও। এর আগে ১৯৭৯ সালে মিশর এবং ১৯৯৪ সালে জর্দানের সঙ্গে চুক্তি করে পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছে ইসরায়েল।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কাটার থেকে আরম্ভ করে ডোনাল্ড ট্রাম্প পর্যন্ত সবাই সমস্যাটি নিয়ে উভয়পক্ষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য সমাধানের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কোন রূপরেখার ভিত্তিতে ফিলিস্তিন সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হবে তার সুস্পষ্ট ধারণা কারও মধ্যে ছিল না! এটি কী দুই রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধান হবে নাকি এক রাষ্ট্রের ভিত্তিতে হবে। প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের মধ্যস্থতায় ১৯৯৮ সালে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। ইয়াসির আরাফাত এবং নেতানিয়াহু ক্লিনটনের উপস্থিতিতে হোয়াইট হাউসে এই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তখনই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের রূপরেখা সুস্পষ্ট রূপ নেয়। তবে এ কথাও সত্যি যে আন্তর্জাতিকভাবেই এ সমস্যা জিইয়ে রাখা হয়েছে নানা কারণে। অনেক কূটনীতিক মনে করেন জাতিসংঘের নিরপেক্ষ অবস্থানের মধ্য দিয়েই এর একটি স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত।

সহিংসতার পেছনে তিন ধর্মের পবিত্র স্থানেই অন্যতম কারণ : সম্প্রতি পূর্ব জেরুসালেমে পাহাড়ের ওপর পবিত্র একটি স্থানে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলি পুলিশের মধ্যে কয়েকদিন ধরে সহিংসতা বৃদ্ধির জেরেই ইসরায়েল এবং হামাসের মধ্যে এই সংঘাত শুরু হয়। এই স্থানটি মুসলিম, খ্রিস্টান এবং ইহুদি তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র। মুসলিমদের কাছে এটি হারাম আল-শরিফ, খ্রিষ্টানদের হলি চার্চ সেপালচার এবং ইহুদিদের কাছে এটি টেম্পল মাউন্ট। এজন্য ৩টি ধর্মের তীর্থস্থান এ মসজিদের আকসার শহর জেরুজালেম।

মুসলমানদের জন্য মাসজিদুল আকসা, খ্রিস্টানদের হলি চার্চ সেপালচার, জেরুজালেম থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মস্থান বেথেলহাম এবং ইহুদিদের তৃতীয় দেওয়াল (থার্ড ওয়াল)। মুসলমানদের প্রথম কেবলা মাসজিদুল আকসা হজরত সোলায়মান (আ.) জিনদের সাহায্যে ৪০ বছরব্যাপী নির্মাণ করেন এবং এ নির্মাণকালীন হজরত সোলায়মান (আ.) মৃত্যুবরণ করেন বলে স্বীকৃত। এরপর জেরুজালেমের অনেক করুণ ইতিহাস রয়েছে। বিভিন্ন রাজা বাদশাহ এবং সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীর দ্বারা দখল পুনঃদখলের মাধ্যমে এ শহরটি একেবারেই তছনছ হয়ে যায়। জেরুজালেম শহরটি আবার পুনর্গঠন করা হয় ৫৪০ খ্রিস্টপূর্বে।

পারস্য সম্রাট নিহামিয়াম-এর পুনর্নির্মাণ করেন। ৪২-৪৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আগিপ্পা তৃতীয় দেওয়াল নামে আল আকসার কাছে দেওয়াল নির্মাণ করেন। পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত অনেক নবী-রাসূলের বিচরণের ভূমি ছিল এটি। বিশেষ করে ইহুদি সম্প্রদায়ের নবী হজরত মুসা (আ.)-এর কর্মক্ষেত্র ছিল এ জেরুজালেম। হজরত মুসা (আ.) তার অনুসারীদের নিয়ে মিসরের ফেরাউনের হাত থেকে বাঁচার জন্য লৌহিত সাগর পাড়ি দিয়ে সিনাই উপত্যকা দিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নেন। প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) সপ্তাকাশে আরোহণের আগে এ জেরুজালেমের মাসজিদে আল আকসাকে কেবলা করে নামাজ পড়েন।

ঐতিহাসিকদের মতে, ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দে হজরত ওমর (রা.) জেরুজালেম দখলের পর দীর্ঘদিন এটা মুসলমানদের দখলে ছিল। ওমর (রা.)-এর সৈন্যদের দ্বারা শহরটি যখন অবরোধ করা হয়, তখন সেখানকার খ্রিস্টান শাসক সফরোনিয়াস আত্মসমর্পণের পূর্বশর্ত হিসাবে খলিফা ওমরের উপস্থিতি কামনা করেন। মধ্যযুগে এটার দখল নিয়ে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী বেশ কিছু ধর্ম যুদ্ধ বা ক্রুসেড অনুষ্ঠিত হয়। ১০৯৯ সালে রোমের খিষ্টানরা জেরুজালেম দখল করে নেয়।

১১৮৭ সালে মিসরের ফাতেমী শাসক সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবী তা রোমানদের কাছ থেকে পুনর্দখল করেন। ১২৪৩ সালে বাইজেন্টাইন খ্রিস্টান শাসক চার্লস্ আবার জেরুজালেম দখল নেন। ১২৪৪ সালে জর্দানের ডেড সি এলাকায় বাইজেন্টাইনরা আবার রোমানদের কাছে চরমভাবে পরাজিত হয় এবং রোমানরা আবার জেরুজালেম দখল করে নেয়। খাওয়ারিজমের শাসক সুলতান মালিক আল মুয়াত্তাম জেরুজালেম আবার রোমানদের থেকে দখল করেন।

১৫৩৮ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত জেরুজালেম তুরস্কের উসমানীয় তথা অটোম্যান মুসলিম শাসকদের দখলে ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের পর ফিলিস্তিনসহ বেশিরভাগ আরব এলাকা চলে যায় ব্রিটিশ-ফ্রান্সের ম্যান্ডেটে। ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার জেমস বেলফার ইহুদিদের লেখা এক পত্রে ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জোর অঙ্গীকার করেন। প্রধানমন্ত্রী বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিন এলাকায় ইহুদিদের আলাদা রাষ্ট্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয় এবং বিপুলসংখ্যক ইহুদি ইউরোপ থেকে স্থানান্তর শুরু হয়। বর্তমানে যার সংখ্যা প্রায় কোটির ঘরে।

দুই.

সম্প্রতিক সময়ে যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান তার জন্য হামাসের দাবি, ইসরায়েল সেখান থেকে এবং নিকটবর্তী মূলত আরব অধ্যুষিত শেখ জারাহ থেকে পুলিশ সরিয়ে নিক। সেখান থেকে ইহুদি বসতিস্থাপনকারীরা ফিলিস্তিনি পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করতে চায়। হামাস এই পদক্ষেপ বন্ধ করার যে আলটিমেটাম দিয়েছিল, ইসরায়েল তা উপেক্ষা করলে হামাস রকেট নিক্ষেপ করতে শুরু করে। পূর্ব জেরুসালেমে পুলিশের সাথে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চলা উপর্যুপরি সংঘাতের ফলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ক্রমশই বাড়ছিল।

এপ্রিলের মাঝামাঝি রমজান শুরু হবার সময় থেকেই এই উত্তেজনা শুরু হয়। এরপর শেখ জারাহ-র কয়েকটি ফিলিস্তিনি পরিবারের ভাগ্য নিয়ে আদালতের প্রত্যাশিত রায় এই ক্ষোভের আগুনে ইন্ধন যোগায়। গত ১০ মে ২০২১, জেরুসালেমে আল-আকসা মসজিদ চত্বর এবং অভ্যন্তরে ঢুকে ইসরায়েলি পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটা, কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেটে তিনশোরও বেশি ফিলিস্তিনি আহত হওয়ার পর গাজা ভূখণ্ড থেকে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েল দিকে রকেট ছোঁড়া শুরু করে।

বদলা নিতে ইসরায়েল গাজায় বিমান হামলা শুরু করে। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবরে অর্ধ শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এ সংঘাত যে বিপজ্জনক চেহারা নিয়েছে তা ২০১৮ সালের পর আর দেখা যায়নি। ২০১৪ সালের পরে এই প্রথম গাজা থেকে জেরুজালেমকে লক্ষ্য করে রকেট ছোঁড়া হয়েছে। কয়েকটি রকেট শহরের উপকণ্ঠে এসে পড়ে। যদিও ইসরায়েলের দিক থেকে খুব বেশি হতাহতের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে, দু’পক্ষকে শান্ত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার কথা বলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র নেড প্রাইস এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের সংঘর্ষ চালানো বন্ধ করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা ‘সীমাবদ্ধ’। তিনি ইসরায়েলে হামাসের রকেট হামলাকে ‘ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার’ এক রূপ হিসেবে উল্লেখ করলেও, যুক্তরাষ্ট্র গাযায় ইসরায়েলি বিমান হামলাটিকে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচনা করেছে কিনা সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করেন।

প্রাইস এও বলেছেন ‘ইসরায়েলের নিজেকে রক্ষা করার এবং রকেট হামলার জবাব দেওয়ার অধিকার রয়েছে’ এবং ‘ফিলিস্তিনি জনগণেরও ইসরায়েলিদের মতো তেমন সুরক্ষার অধিকার রয়েছে।’ যা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর হুশিয়ারি বলে মনে করা হচ্ছে।

১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র কিছু জায়গার অধিকার পায়। ২০০৪ সালে ফিলিস্তিনিদের শক্তিশালী নেতা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর পর ফিলিস্তিন আন্দোলনের গতি স্তিমিত হয়ে পড়ে। আরাফাতের মৃত্যুর পর বড় ঘটনা হচ্ছে ৩১ জুলাই ২০১৯ সালে জাতিসংঘের ১৩৮টি সদস্য দেশের ভোটে রাষ্ট্র হিসেবে ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি পাওয়া। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন শান্তি অগ্রগতিতে সবচেয়ে বাধা হয়ে কাজ করছেন বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু কট্টর ও কঠিন প্রকৃতির লোক। এক রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পক্ষের লোক হওয়ার কারণে সমাধানের বিষয়ে পূর্বের আলোচনার আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। সাম্প্রতিক হামলার নেপথ্য নায়কও বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।

ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এটিকে উৎসাহিত করেছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কারণ গত দুইবছর ধরে ইসরায়েলে একের পর এক নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছেনা। সর্বশেষ মার্চ ২০২০ এর নির্বাচনের পরও নেতানিয়াহু শরিক জোগাড় করে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হলে প্রেসিডেন্ট বিরোধী ইয়েস আডিট দলের নেতা ইয়ার লাপিডকে সরকার গঠনের সুযোগ দেন। সরকার গড়তে হলে আরব দলগুলোর সমর্থন দরকার লাপিডের। সেই চেষ্টা চালানোকালেই পূর্ব জেরুসালেমের আরব অধ্যুষিত এলাকা শেখ জারাহ থেকে চারটি ফিলিস্তিনি পরিবারকে বাড়িছাড়া করার এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে গত কয়েক সপ্তাহ ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। এরপর আসে আল-আকসায় হামলা এবং গাজায় আক্রমণের ঘটনা। এমন পরিস্থিতে আরব দলগুলোর সঙ্গে সরকার গঠন নিয়ে লাপিডের সমঝোতা অসম্ভব।

বরং উল্টো তাকে এবং তার বর্তমান শরিকদেরও এখন সরকার ও সেনাবাহিনীকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আর এই সংঘাতের রাজনৈতিক ফায়দা এখন নিশ্চিতভাবেই পাবেন নেতানিয়াহু। লাপিড সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে ব্যর্থ হলে ইসরায়েলে আরেক দফা নির্বাচনের সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে চলতি এই বিরোধ কাজে লাগিয়ে নেতানিয়াহু জয়ী হতে পারবেন। তবে নেতানিয়াহু বারবার একই খেলায় জয়ী হবে সত্য নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার জন্য ইসরায়েলকে ভারি মূল্য দিতে হবে। বাইডেন প্রশাসনও এককভাবে আর ইসরায়েলকে হামলার সমর্থন দিচ্ছে না।

অপরদিকে এ কথাও ভাবতে হবে এবার ইসরায়েলের সাধারণ জনসাধারণকেও দেখা গেছে এসব হামলার বিরুদ্ধে কথা বলতে ও বিক্ষোভ দেখাতে। পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষ আর এ রকম অস্থিরতা দেখতে চায় না বলেও সম্প্রতি সময়ে দেশে বিক্ষোভ প্রতিবাদে সেটাই প্রমাণ করে।

তিন.

২০১৯ সালের শেষের দিকে চীনের উহানে কোভিড-১৯ এর কথা শুনতে পাই। তা বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে ২০২০ সালের শুরুর দিকে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন দেশে দেশে ও বিশ্বময় আমাদের হানাহানির জন্য প্রকৃতিগত ভাবেই মানব জাতির জন্য এই দুর্ভোগ নেমে এসেছে। এখনো দেশে দেশে করোনার মৃত্যুর মিছিল চলছে তার মধ্যেও এসব হানাহানি আর রক্তপাত থেমে নেই। কাশ্মীরে দিনের পর দিন অবরোধ দিয়ে মানুষগুলোকে জিম্মি রাখা আর সিরিয়ায় দিন-রাত গোলা বর্ষণ আর উপর্যপোরি রকেট হামলায় প্রাণ হারা মানুষের আর্তনাদ মানব জাতিকে প্রকম্পিত করছে। সিরিয়ায় একটা রক্তাক্ত শিশুর কান্নায় ভারাক্রান্ত হয়েছিল মানুষ।

সামাজিক মাধ্যমে শিশুটিকে নিয়ে স্ট্যাটাসটি পড়ে চোখে পানি ধরে রাখতে পারেনি অনেকে। তিন বছরের এক যুদ্ধাহত শিশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ঠিক আগ মুহূর্তে বলেছিল ‘আমি আল্লাহকে বলে দিবো, তোমরা আমার প্রতি অন্যায় করেছো’। সে কান্না স্তব্দ করে দিয়েছিলো শান্তির নামধারী অশান্ত বিশ্ব মোড়লদের। সিরিয়ান এই শিশুটি সভ্যতা, যুদ্ধ, দ্বন্দ্ব, আদর্শ- এগুলো হয়তো পরিষ্কার করে বুঝতে পারেনি।

কিন্তু তার ‘বিশ্বাস’ কতো প্রবল! ‘আমি আল্লাহকে সব বলে দিবো!’ সে নিশ্চিত সে আল্লাহর কাছে ফিরে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়; আল্লাহর কাছে সে নালিশ করবে! অনেকেই বলছেন, পৃথিবীর কারো কাছে সে অভিযোগ করেনি শিশুটি। কারো কাছে সে তাকে মারার বিচার চায়নি। সে জানে এবং সবাইকে জানিয়ে দিয়ে গেল- এই আদর্শহীন একচোখা বিবেকহীন বিশ্বের কাছে কিছু চাইতে নেই।

লেখক: বিল্লাল বিন কাশেম
কবি, লেখক ও কলামিস্ট

Leave a Comment

error: Content is protected !!