করোনা কি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে?

সিনথিয়া সুমি: করোনা কি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে? জীবনের মধুর সময় বলা হয়ে থাকে ছাত্র জীবনকে। আর ছাত্র জীবনের সবচেয়ে সেরা সময় হিসেবে বিবেচনা করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময়টাকে। হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে পেছনে ফেলে অনেক কষ্ট, ত্যাগের পরে অর্জন করে নিতে হয় কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সিট।

মূলত একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে হাজারো তারুণ্যের স্বপ্নময় মুখ। কিন্তু যদি সে ক্যাম্পাস সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়, তবে তা একটি বিরানভূমিতে পরিণত হতে সময় লাগে না। একটি দেশ ও জাতি যখন অশিক্ষার অভিশাপ মুক্তির আশা করছিল, ঠিক তখনই বৈশ্বিক মহামারির আঘাত থেকে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ রাখতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। চীনের উহান প্রদেশে শনাক্ত হওয়া করোনা ভাইরাস এখন বিশ্বব্যাপী আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে ।

গত বছর লকডাউনের কবলে পরে ১৭ ই মার্চ থেকে করোনা সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশ সরকার প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে ৩১ ই মার্চ ২০২০ পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। এরপর ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হচ্ছে কিন্তু খুলে দেওয়া হচ্ছে না। এ বছরের ২৩ মে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। এখন ছুটি বাড়ানো হয়েছে ১২ জুন পর্যন্ত। কারণ শিক্ষার্থীরা করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় অক্ষম। তবে একটি প্রশ্ন থেকে যায় করোনা কি শুধু শিক্ষার্থীদের উপর আঘাত হানে ? অথবা করোনা কি শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ?

এখন ২০২১ সাল, বন্ধের ১৪ মাস পেরিয়ে গেলেও খোলেনি কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে অনেকটাই শিথিল করোনা বিধি নিষেধ। চলছে গণপরিবহন , অফিস- আদালত, শপিংমল, কলকারখানা বন্ধ কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যানজট, জনজট মহাসড়কে চলছে সব রকমের যানবাহন। শুরু হয়েছে রেল ও নৌ যান চলাচল।

খুলেছে অফিস আদালত পুরোদমে সচল শপিং সেন্টারগুলো সবকিছুই যখন সচল তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মেয়াদ কেবল বেড়েই চলেছে। যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি সেরেছে শিক্ষা অধিদপ্তর কিন্তু কবে চালু হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তা অনির্দিষ্ট। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে সরব শিক্ষার্থীরাও। এরই মাঝে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বাস্থ্য বিধি মেনে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবিতে মানববন্ধন ও পালন করেছে।

করোনা ভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ঘরবন্দী। স্কুলের ঘন্টার ধ্বনি, শ্রেণিকক্ষে বসে ক্লাস ও পরীক্ষা এ সবকিছু থেকে দীর্ঘদিন ধরে দূরে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। এতোদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পরিবেশটাই যেন বদলে গিয়েছে। অনলাইনে দূর শিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলেও শহর, গ্রাম নির্বিশেষে বহু শিক্ষার্থী কোনো ক্লাসই করতে পারেনি। প্রায় দেড় বছরের শিক্ষা বিরতীতে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত অভিভাবকরাও।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, এতে করে বিষন্ন হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থীরা বাড়ছে অনলাইন আসক্তি। এভাবে শিক্ষার্থীরা বাসায় বসে বোরিং সময় কাটাচ্ছে। এমনকি ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত অনেকেই আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছে। করোনার ছোবলে অসংখ্য শিশু-কিশোরের জীবনে নেমে এসেছে এমন অমানিশা। এদিকে অটো পাসের প্রভাবে শিক্ষার্থীরা পড়ার টেবিল ছাড়া। কেউ মহা খুশি, কেউবা ভবিষ্যৎ অন্ধকার ভেবে দিশেহারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে হিমশিম খাচ্ছে। শিক্ষার গতিশীলতা ব্যাহত হওয়ায় বৈশ্বিক শিক্ষাব্যবস্থা স্থবির হয়ে পড়েছে। এতে শিক্ষার্থীদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্থ , আর তারচেয়েও বেশি হতাশাগ্রস্থ তাদের পরিবার। যেখানে পড়ালেখা শেষ করে পরিবারের হাল ধরার কথা সেখানে বেকার হয়ে ঘুরছে। কেউবা শিক্ষা জীবন থেকে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিচ্ছে।

আমাদের দেশে অনেক গরীব বাবা-মা এবং পরিবার আছে যারা তাদের সন্তানের মুখপানে দিকে তাকিয়ে আছে কবে তাদের সন্তান লেখাপড়া শেষ করে চাকরী করে পরিবারের অভাব পূরণে সহযোগিতা করবে। কিন্তু সেই সুযোগ কোথায় ? এমন পরিস্থিতিতে অনেকেই বৃদ্ধ মা-বাবা, ভাই- বোনের মুখে অন্ন তুলে দিতে পেশা পরিবর্তন করে বিভিন্ন কাজে শামিল হচ্ছে। কেউবা লোকলজ্জার ভয়ে বাইরে গিয়ে কাজ করছে। অনেকেই তাদের সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে চিন্তিত হয়ে পরেছে। এমন চলতে থাকলে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন হবে। এহেন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। দেশে দারিদ্র্যের কারণেই সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনলাইন ক্লাস চললেও সেই ক্লাসে অনেক শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করতে পারে না। করণ অনেকেরই ডিভাইস নেই এবং গ্রামে থাকার কারণে নেটওয়ার্ক সমস্যা এমনকি আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের ডাটা কেনার খরচ বহন করতে পারে না।

অন্যদিকে গ্রাম কিংবা শহরে লক্ষ্য করলে দেখা যায় স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জোরপূর্বক বিয়ে দেয়া হচ্ছে। কারণ এই কারোনা কবে স্বাভাবিক হবে তার ঠিক নেই। দীর্ঘদিন বাসায় থাকার কারণে পরিবার এবং সমাজের কাছে মেয়েদের বোঝা মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে মেয়ের বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে তা নিয়েও যেন দুশ্চিন্তার শেষ নেই। সমাজের লোকে মেয়ে এবং পরিবারকে নানান কথা শোনাচ্ছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং তাদের স্বপ্নের প্রদীপ নিভে যেতে বসেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সচল থাকলে এমন হাজারো কথা থেকে মুক্তি পেতো শিক্ষার্থীরা। যেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যতীত সব কিছুই সচল। বলা হয়ে থাকে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। কিন্তু এই মেরুদণ্ড আজ ভাঙতে শুরু করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট বিনীত অনুরোধ শিক্ষার্থীদের কথা ভেবে স্বাস্থ্য বিধি মেনে অবিলম্বে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিন। অন্যথায় তাদের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পরবে।

লেখকঃ শিক্ষার্থী
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
গোপালগঞ্জ।

Leave a Comment

error: Content is protected !!