তাজমহল এর ঘরে কী রহস্য লুকিয়ে আছে?

ভারতের আগ্রায় অবস্হিত তাজমহল নিয়ে জনমনে কৌতূহলের শেষ নেই| তাজমহলকে সত্যিকারের ভালোবাসার এক প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়| যমুনা নদীর তীরে অসামান্য সুন্দর এই সৌধটি তৈরি হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে|

মোগল সম্রাট শাহজাহান তার মৃত স্ত্রী মমতাজের স্মৃতি ধরে রাখতে তাজমহল তৈরি করেছিলেন| ১৯৮২ সালে তাজমহলকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঘোষণা করে ইউনেস্কো| ইট, লাল রঙের পাথর এবং সাদা মার্বেলের তৈরি এই সৌধটি জুড়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য আর শিল্পকলা সারা পৃথিবীর মানুষকে মুগ্ধ করেছে| তাজমহল শুধু ভারত নয়, সারা বিশ্বের মধ্যেই পর্যটনের অন্যতম প্রধান একটি আকর্ষণ| কিন্তু তাজমহল নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ইতিহাসে সন্তুষ্ট নন বিজেপির এক নেতা রজনীশ সিং| তাজমহলের তালাবদ্ধ ২২টি কক্ষ খুলে দিতে আদালতে আবেদন করেন তিনি| সম্প্রতি তার এই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে এলাহাবাদের উচ্চ আদালত|

বছরের পর বছর ঐতিহাসিক তাজমহলের ২২টি কক্ষ তালাবদ্ধ| রজনীশ সিং বলেন, তালাবদ্ধ কক্ষে কি আছে, সত্যটা যাই হোক প্রকাশ্যে আসা উচিত| আবেদনে দাবি করেন, তিনি দেখতে চান তাজমহলের ভেতরের তালা দেওয়া ঘরগুলোতে হিন্দু দেবতা শিবের একটি মন্দির রয়েছে বলে যে দাবি ঐতিহাসিকরা এবং ভক্তরা করেন তা যথার্থ কি না|

তবে আদালত আবেদন খারিজ করে বলেছে, তাজমহলের সুরক্ষার দায়িত্ব আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার হাতে| ইসু্যগুলো আদালতের বাইরে রাখা উচিত| এসব ইতিহাসবিদের কাছে ছেড়ে দেওয়া উচিত| এরপরই তাজমহলের তালাবদ্ধ ঘরগুলোতে কি রহস্য লুকিয়ে রয়েছে তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে|

বিবিসির এক খবরে বলা হয়েছে, তালা দেওয়া যে কক্ষগুলোর কথা রজনীশ সিং তুলছেন সেগুলোর অধিকাংশই সৌধের ভূগর্ভস্হ অংশে অবস্হিত| তাজমহলের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান রাখেন এমন অনেক মানুষের মতে, ভূগর্ভস্হ ঐ ঘরগুলোর ভেতর আদৌ কোনো রহস্য নেই|

মোগল স্হাপত্যের একজন শীর্ষ বিশেষজ্ঞ এবা কোচ, যিনি তাজমহলের ওপর গবেষণাধর্মী একটি বই লিখেছেন, তার গবেষণার সময় ঐ সমস্ত কক্ষ এবং ভেতরের সমস্ত প্যাসেজ বা পথের ভেতর ঢুকে খুঁটিয়ে দেখেছেন এবং ছবি তুলেছেন| তিনি লিখেছেন, তাজমহলের নিচে ভূগর্ভস্হ ঐ কক্ষগুলো তৈরি করা হয়েছিল ‘তাহখানা’র অংশ হিসেবে| মোগলরা গরমের মাসগুলোতে শরীর শীতল রাখতে এমন ভূগর্ভস্হ কক্ষ তৈরি করত|

সৌধের নিচে নদীমুখী একটি চত্বরে সারিবদ্ধ বেশ কয়েকটি কক্ষ রয়েছে| এবা কোচ নদীর সমান্তরাল এরকম ১৫টি কক্ষের কথা লিখেছেন| সরু একটি করিডোর দিয়ে ঐ চত্বরে যাওয়া যায়| এগুলোর মধ্যে সাতটি কক্ষ বেশ বড় যেগুলোর প্রতিটির দুই দেওয়ালে বর্ধিত অংশ রয়েছে| ছয়টি কক্ষ চার দেওয়ালের এবং দুটি কক্ষে দেওয়ালের সংখ্যা আটটি করে| বড় আকৃতির কক্ষগুলোর সামনে রয়েছে কারুকার্যখচিত খিলান বা তোরণ— যেগুলোর ভেতর দিয়ে যমুনা দেখা যায়|

ঘরগুলোর সাদা চুনকাম করা দেওয়ালের নিচে এবা কোচ রঙিন কারুকার্যের নমুনা দেখেছেন| তিনি লিখেছেন, এটা নিশ্চিত যে সম্রাট যখন এই সৌধে আসতেন তখন এসব প্রশস্ত, সুন্দর এবং শীতল কক্ষগুলো ছিল তার, সহযোগীদের এবং তার নারীদের আদর্শ বিশ্রামের জায়গা| এ ধরনের ভূগর্ভস্হ গ্যালারি মোগল স্হাপত্যের অংশ ছিল| পাকিস্তানের লাহোরে মোগলদের একটি দুর্গে জলাধারের সমান্তরাল এমন সার দেওয়া ভূগর্ভস্হ কক্ষ রয়েছে| সম্রাট শাহজাহান অনেক সময় যমুনা নদী দিয়ে নৌকায় করে তাজমহলে আসতেন| অনেক সিঁড়ি বাঁধা একটি ঘাটে নেমে তাজমহলে ঢুকতেন তিনি|

ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষক অমিতা বেগ যিনি ২০ বছর আগে তাজমহলের ভূগর্ভস্হ ঐ অংশে ঢুকেছিলেন| তিনি পরে লেখেন, সেখানে গিয়ে চমত্কার কারুকার্যে মোড়া একটি করিডোর দেখেছিলাম| ঐ করিডোর দিয়ে প্রশস্ত একটি চত্বরে যেতে হয়| পরিষ্কার বোঝা যায় সম্রাট এই করিডোর দিয়ে ঢুকতেন|

অন্য অনেক পুরোনো সৌধের মতো তাজমহলকে ঘিরেও অনেক গল্প, জনশ্রুতি রয়েছে| ভারতে, অনেক দিন ধরে একটি কল্পকথা চলে আসছে যে তাজ আসলে একটি হিন্দু মন্দির ছিল| দেবতা শিবের নামে মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল|

দিল্লিতে ইতিহাসবিদ রানা সাফাভি বলেন, গত এক দশকে এসব কল্পকথা আর গুজবের তত্ত্ব নতুন করে কট্টর হিন্দুদের একটি অংশের মধ্যে প্রাণ পেয়েছে| এবা কোচও লিখেছেন, তাজমহলকে নিয়ে যতটা পাণ্ডিত্যপূর্ণ গবেষণা হয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে কল্পকথার চর্চা।

Leave a Comment

error: Content is protected !!