মোবাইল গেমসে আসক্তি যুব সমাজের এগিয়ে চলার অন্তরায়

প্রভাষক নীলকন্ঠ আইচ মজুমদার: দিন দিন বেড়েই চলছে মোবাইল গেমসে যুব সমাজের আসক্তি। প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে কিংবা শখের বসে অবুঝ সন্তাদের হাতেও আমরা তোলে দিচ্ছি মোবাইল সেট। একবারও চিন্তা করছি না এর ফলাফল কি হতে পারে?

ধীরে ধীরে ছোট্ট শিশুটির মোবাইল ফোন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে যাচ্ছে। খাওয়া কিংবা পড়া না হলেও চলবে চাই একটা মোবাইল অথবা মোবাইল না থাকলে খাওয়া ও পড়া কোনটাই নয়। এই সব শর্তের মাঝেই বেড়ে উঠছে আমাদের ছোট্ট শিশুটি। যে সমস্ত গেম মোবাইলে খেলা হয় তাকে মোবাইল গেমস বলে। মূলত বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এ জাতীয় গেমের উদ্ভব ঘটে।

তবে স্মার্টফোন আবিষ্কারের পর মোবাইল গেমসের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এটি খেলাধুলার বা সময় কাটানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় প্লাটফর্ম।

বাসা, রাস্তা ঘাট, মাঠ, হোটেল ,রেস্তোরা, শপিংমলসহ এমন কোন জায়গা নেই যেখানে আড্ডাতে মোবাইল গেমস নেই। ছোট বড় সকল স্তরের মানুষই কমবেশি আসক্ত হচ্ছে এ খেলায়। মনে হচ্ছে জীবনের সব আনন্দ যেন এ খেলায় মিশে আছে। এগুলো ছাড়া যেন আর কোন কিছুতেই আনন্দ খুঁজে পাওয়া যাবে না।

ব্যবহারকারীরা মোবাইলে বিভিন্ন এ্যাপস ব্যবহার করে এসব গেমসে আসক্ত হচ্ছে। আর নিজের ভবিষৎ কে ধাবিত করছে অন্ধাকারের দিকে। এ সমস্যাটা কম বেশি আজকাল সকল পরিবারেই। আমরা এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে সামান্য সময়ের জন্য সন্তানদের সাথে ভালো ও আনন্দঘন একটু সময় কাটাতে পারছি না। আবার মোবাইলের লোভ দেখিয়ে সন্তানদের কাছ থেকে আদায় করে নিচ্ছি বিভিন্ন কাজ। সন্তানরা বায়না ধরছে স্মার্টফোন কেনার জন্য। আমরাও মেনে নিচ্ছি প্রয়োজনীয়তা না দেখেই। কিছু সময় নির্ভার থাকার জন্য সামনের নষ্ট ভালোবাসার জন্য প্রস্তত হচ্ছি ।

আবার মোবাইল গেমসের পাশাপাশি কেউ ঢুকে যাচ্ছে পর্নোগ্রাফিতে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। দিনের অনেকটা সময়ই ব্যয় করছে এসব কাজে। অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকরা যখন ব্যস্ত হয়ে পড়ছে এসব দিকে সেক্ষেত্রে সন্তান আর পিছিয়ে থাকবে কেন ? তারাও উৎসাহ পাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে। দেখা যায় এক জায়গায় পাঁচজন আড্ডা দেওয়ার জন্য বসলেও কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। সবাই ব্যস্ত মোবাইল নিয়ে।

বিশেষ করে ছুটির দিনেতো এর ব্যবহার বেড়ে যায় বহুগুণ। টিভি সেট যেন অকার্যকর। মোবাইল ছাড়া আড্ডাই যেন অপূর্ণ রয়ে যায়। মোবাইলের অহেতুক ব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এদের দেখলে মনে হয় এটাই তাদের জীবন। অন্যান্য বয়সের চেয়ে এদিকে বেশি আসক্ত হচ্ছে যুব সমাজ।

সবচেয়ে বড় কথা হলো এ খেলার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের জুয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে দিন দিন যা সত্যিকার অর্থে ভাবিয়ে তোলছে সমাজ ব্যবস্থাকে। এ থেকে অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি হচ্ছে সামাজিক বিশৃংখলা। চিকিৎসা বিজ্ঞানের মতে দীর্ঘ সময় ধরে এসব খেলার ফলে চোখ ও মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়ে মাইগ্রেনের ব্যাথা হয়। গেমসের ঘটনাগুলো খোলোয়ারের মস্তিষ্ককে তাড়িত করে।

ফলে অনিদ্রা, ঘুমের সময় হাত-পায়ের ঝাঁকুনি, হাঁটা বা কথা বলা এমনকি দুঃস্বপ্ন দেখাসহ বেশ কিছু ঘুম সংক্রান্ত রোগ হতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে বসে থেকে খেলার ফলে পিঠে ব্যথাও হতে পারে। গেইমে আসক্ত হয়ে ঠিকমতো গোসল করা, দাঁত মাজা, ঠিক সময়ে খাবার খাওয়া ইত্যাদি না করার ফলে শারীরিক দুর্বলতা, অবসাদগ্রস্ততাসহ বিভিন্ন রোগের জন্ম দিতে পারে। এছাড়াও অতিরিক্ত গেইম খেলা চোখ ও কানের সমস্যা তৈরি করে, ঘাড়ে ব্যথা, কুইনতে ব্যথা, মূত্রের বেগ ধারণের অক্ষমতার জন্ম দেয়। শারীরিক সমস্যার পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সমস্যাও তৈরি হয়। বেশির ভাগ পরিবার এ নিয়ে চরম বিরক্তি প্রকাশ করছে সন্তানদের উপর।

সম্প্রতি লকডাউন থাকার কারণে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাস পরিচালিত হচ্ছে অনলাইনের মাধ্যমে। এ সুযোগে বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর হাতে চলে এসেছে এনড্রয়েড মোবাইল সেট। পরিবারের সামর্থ থাকুক বা না থাকুক কষ্ট অথবা ঋণ করে হলেও কিনতে হবে এনড্রয়েড ফোন।

ইতোমধ্যে প্রায় সকল শিক্ষার্থীই শিখে গেছে মোবাইল পরিচালনার ব্যবহার বিধি। শুধু শিক্ষার্থী নয় যেসব শিশুরা এখনও স্কুলে যাচ্ছে না তারাও ব্যবহারে অনেক পটু। এসব চিত্র প্রায় পরিবারেরই। হয়তো স্থানভেদে একটু ভিন্ন হতে পারে। যুগের চাহিদার কারণে পরিবর্তন হবে মানুষের আচার আচরণ চালচলন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই পরিবর্তনের সাথে যদি আমরা খাপ খাইয়ে নিতে না পারি তাহলে ভয়াবহ বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবি এ না মানার কোন উপায় নেই। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর হাতে মোবাইল সেট আসার কারণে তাদের মাঝে যোগাযোগের পরিমাণটা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক বেশি এবং অনেক ক্ষেত্রেই তৈরি হয়েছে বিভিন্ন গ্রুপ। এসব গ্রুপের মাধ্যমে চলে বিভিন্ন তথ্য আদান প্রদান। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাঠ নেই এবং যেসব জায়গায় মাঠ আছে সেখানেও খেলা নেই। যেখানে মাঠ আছে তারই পাশে দেখা যাচ্ছে প্রায় সবাই মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে অনেকেই।

সংস্কৃতির চর্চ্চা কমে এসেছে শূন্যের কাতারে। প্রযুক্তি মানুষকে এত অলস করে দিয়েছে। যে কারণে মাঠের খেলাধুলা স্থানীয় পর্যায়ে নেই বললেই চলে। সবচেয়ে বড় কথা হলো মানুষ বিনোদন হিসেবে এটাকে বেছে নিচ্ছে কিন্তু সমস্যাটা হলো মাত্রারিক্ত। করোনা কালে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মোবাইল গেমসের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।

সংস্কৃতির ক্ষেত্রগুলি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ এই গেমসগুলোকে বিনোদন হিসেবে ব্যবহার করছে। পাবজি, ফ্রি ফায়ার, কল অফ ডিউটি, ফিফা সকার, লুডু কিং, এইট বল পুল , ক্যারম পুল, ওয়ার্ড উইথ ফ্রেন্ডস ২, এ্যাসপাল্ট ৯ , ক্লাস অফ ক্লেনস, তিন পাত্তি, ক্লেস রয়্যাল, মর্ডান কমব্যাট, সাবওয়ে সার্ফার, অ্যামিয়ার ক্রীড, পেস ২০২০ ড্রিম লীগের মতো নামের এসব খেলা যুব সমাজকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এসব মোবাইল গেমসের মাধ্যমে আমাদের অর্জনটা কি ? তৈরি হচ্ছে এক ধরনের মানসিক সমস্যা। যে নামগুলি এখানে সংযুক্ত করা হয়েছে এলাকা বিশেষে একেকটি খেলা চালু রয়েছে একেক জায়গায়।

বর্তমানে যদি বলা হয় যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা কোনটি তাহলে নাম চলে আসবে মোবাইল গেমস। অনেক ক্ষেত্রে সন্তানকে শান্ত রাখতে অভিভাবকরাই তোলে দিচ্ছেন হাতে মোবাইল ফোন। ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই তাকে খারাপ বলা যাবে না দেখতে হবে ব্যবহারটা কোন পর্যায়ের। দীর্ঘ সময় ধরে অপ্রয়োজনে একসাথে চলতে থাকলে অবশ্যই তাকে আসক্তির পর্যায়ে ধরে নেওয়া যায়। আর এটা এমন যে শুরু হলে দিন দিন এর মাত্রা বাড়তেই থাকে। অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীদের সকল ক্ষেত্রে ব্যর্থতার খর্গ নেমে আসছে ।

তুলনামূলকভাবে মেয়েদের চেয়ে ছেলেরা অনেক এগিয়ে এসব বিষয়ে। যার ফলে একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় শিক্ষা ব্যবস্থায় ছেলেদের ফলাফলে কিভাবে বিপর্যয় ঘটছে এবং কিভাবে পরিবারের নিয়ন্ত্রণহীন হচ্ছে। এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ব্যবহারকারীদের ব্যবহার করতে বাঁধা দিলে মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে। এসব আসক্তির ফলে সব কিছুর মধ্যেই অমনোযোগিতার সৃষ্টি হচ্ছে। গেমস শুধু একাই খেলা হয় না অনেকে একসাথে বসেও বিভিন্ন গেমস খেলা যায়। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগ। আজকের সভ্যতার উন্নয়নের পিছনে ইন্টারনেটের অবদান অনেক বেশি। তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে দিচ্ছি বিশ্বকে। কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকার সুযোগ নেই।

ইন্টারনেটের সুবিধা অনেক বেশি আর যেটুকু কুফল সাধারণ মানুষ পাচ্ছে তা অবাধ ব্যবহারের ফলে। বিশ্বের অগ্রসরতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এবং তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর দেশ গড়তে হলে ইন্টারনেটের কোন বিকল্প নেই কিন্তু এর ব্যবহার বিধি যদি সঠিকভাবে না হয় তাহলে দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাবে এটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। মাদকাসক্তির মতো ইন্টারনেটে মাত্রাতিরিক্ত থাকা বা গেমস খেলাও আসক্তি। এটা কোন অংশেই মাদকাসক্তির চেয়ে কম নয়।

দুটোর মধ্যে পার্থক্যটা হচ্ছে গেমসটা যেমন আচরণগত আসক্তি আর মাদকাসক্তিটা নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি। এসব আসক্তির ফলে যেমন পারিবারিক জীবন বাঁধাগ্রস্থ হবে তেমনি সামাজিক দক্ষতাও কমে যাবে ফলে ব্যক্তিগত জীবন হবে বর্ণহীন। একটি মাদকাসক্তি যেমন মানুষকে নষ্ট করে দেয় তেমনি মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারও মানুষকে বিভিন্নভাবে নষ্ট করতে পারে। তবে এটা কোন নিষিদ্ধ বিষয় নয় তবে তা অতিরিক্ত ব্যবহার অবশ্যই ক্ষতিকারক।

মোবাইল গেমসের আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে হলে আপনাকে নিজেই উদ্যোগী হতে হবে। এবং অভিভাবকদের উচিৎ হবে বারবার চিন্তা করা সন্তান কতটুকু নিজের দায়িত্ব নিতে সক্ষম। সন্তানের সাথে আলোচনায় আসা এবং সময় দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সদস্যরা মিলে পারিবারিক খেলায় মেতে উঠতে হবে। আপনার সন্তানদের গেমসে আসক্তির ক্ষতিকর দিক গুলি বুঝাতে হবে।

গেমসের লাগাম টেনে ধরার জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া যেতে পারে এবং এই সময়সীমা মেনে চলার ক্ষেত্রে নিজেকে কঠোর হতে বাধ্য করুন অথবা ডিভাইস গুলোকে দূরে রাখতে হবে। ভালো মানের বই পড়া, ছবি আঁকা, সিনেমা দেখা, গান শুনা, প্রার্থনা, ব্যায়াম, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়া কিংবা বন্ধুদের সাথে মাঠে খেলতে দেওয়ার মতো কাজ করতে হবে সন্তানদের জন্য। মনে রাখতে হবে এটা কোন আইন করে সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কেবল আত্ম সচেতনতাই পারে এই আসক্তি থেকে মুক্ত করতে।

লেখক পরিচিতি
শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মী
প্রভাষক, আলীনগর কারিগরি ও বাণিজ্যিক কলেজ
সভাপতি, ঈশ্বরগঞ্জ প্রেসক্লাব

Leave a Comment

error: Content is protected !!