রাজাকারের তালিকা তৈরিতে সমন্বয়হীনতা

রাজাকারের তালিকা তৈরিতে সমন্বয়হীনতা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী রাজাকার, আলবদর, আলশামসের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরিতে তেমন কোনো কার্যকর অগ্রগতি নেই। সংশ্লিষ্টদের মধ্যে চরম সমন্বয়হীনতার কারণেই মূলত এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তালিকা তৈরির জন্য গঠিত উপকমিটির সদস্যরা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন।

কেউ বলছেন, এখন পর্যন্ত উল্লেখ করার মতো কোনো কাজই হয়নি। আবার কেউ বলছেন, তালিকা তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। ফলে বিষয়টি নিয়ে একধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। 

এদিকে স্বরাষ্ট্র ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ করছেন না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত উপকমিটি কাজ করছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে বলেন, রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজে খুব বেশি অগ্রগতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এখন পর্যন্ত নীতিমালাও করা যায়নি। তবে নীতিমালা তৈরির কাজ করছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শাজাহান খান। তিনি এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। 

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জেলায় জেলায় যে তথ্য সংগ্রহ কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, সেগুলো বন্ধ আছে। শাজাহান খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির মাধ্যমে তালিকা করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাই চূড়ান্ত। অপর এক প্রশ্নের জবাবে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা নতুন করে তালিকা তৈরি করছি না। বরং পুরোনো তালিকাই নতুন প্রজন্মের সামনে আনতে উদ্যোগ নিয়েছি। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানুক কারা দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। কারা পাকিস্তানিদের সহায়তা করেছে। 

অপরদিকে কমিটির অপর এক সদস্য সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবি তাজুল ইসলাম বুধবার বলেন, রাজাকার, আলবদর ও আলশাসমসের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তবে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো আগ্রগতি এখনো হয়নি। আমরা যেভাবে আশা করেছিলাম, সেভাবে এগোতে পারছি না। তালিকা তৈরির জন্য এটা পাওয়া যায় তো অন্যটা পাওয়া যায় না। অনেকদিন আগের ঘটনা তো, তাই সমস্যা হচ্ছে। 

নীতিমালা তৈরির বিষয়ে এবি তাজুল ইসলাম বলেন, নীতিমালা বা ওয়ার্কিং পেপার তৈরির কাজ করছেন শাজাহান খান। আপনারা তার সঙ্গে কথা বলেন। 

জানতে চাইলে কমিটির সভাপতি মো. শাজাহান খান বলেন, ইতোমধ্যে আমরা ১৫০টি উপজেলার স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার, আলবদর ও আলশামসদের তালিকা পেয়েছি। প্রাপ্ত তালিকায় কিছু সমস্যা আছে। গড়ে একটি লিস্ট করে উপজেলাগুলো থেকে পাঠানো হয়েছে। কে রাজাকার, কে আলবদর, কে আলশামস, তা পরিষ্কার করে বলা হয়নি। সুতরাং সেগুলো যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। তবে ৩৫ থেকে ৪০টি উপজেলার তালিকা চূড়ান্তভাবে এসেছে, যা চাইলে এখনই তা প্রকাশ করতে পারব। 

তাতে মোট সংখ্যা কত-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই মুহূর্তে বলা যাবে না। তিনি আরও জানান, এখন আমরা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে একটি বৈঠক করব। প্রাপ্ত তালিকা আংশিক প্রকাশ করব না, পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ করব। কারণ, আংশিক প্রকাশ করলে সমালোচনা হবে। একসঙ্গে প্রকাশ করলে সমালোচনা যা হওয়ার একবারই হবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব। রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিকা প্রণয়নে নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের জবাবে শাজাহান খান বলেন, যেহেতু আইন হয়েছে, সেহেতু নীতিমালার দরকার নেই। আমরা আইনের আলোকে কাজ করব। 

তিনি আরও জানান, আওয়ামী লীগের জেলা সম্মেলন ও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজে অনেক সময় দেওয়ার কারণে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের তালিকা তৈরিতে বিলম্ব হয়েছে। এখন অনেকটা ফ্রি হয়েছি। আশা করি দ্রুততম সময়ের মধ্যে তালিকা প্রকাশ করা যাবে। 

এদিকে রাজাকারের তালিকা প্রণয়ন কমিটির সদস্য এবং জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। তিনি আরও বলেন, আমরা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাইয়ে লম্বা সময় নিয়ে কাজ করেছি। এ কারণে রাজাকারদের তালিকা তৈরির কাজ কিছুটা পিছিয়ে গেছে। এখন রাজাকারের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করব। খুব কম সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারব বলে আশা করি। 

নীতিমালা ছাড়া কীভাবে তালিকা তৈরি করবেন-এমন প্রশ্নের জবাবে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, নীতিমালার খসড়াও প্রায় তৈরি হয়ে গেছে। নীতিমালা চূড়ান্ত করতে বেশি দিন সময় নেব না। আগের কমিটি ভেঙে গত ১৩ এপ্রিল রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের তালিকা তৈরির জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. শাজাহান খানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট উপকমিটি গঠন করা হয়। বাকি দুই সদস্য হলেন জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ ও আওয়ামী লীগের এ বি তাজুল ইসলাম। স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী রাজাকারদের তালিকা প্রকাশের বিষয়টি ২০১৯ সালের এপ্রিলে সামনে আসে। ওই বছর ২৮ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বেতনভাতা নেওয়া রাজাকারদের তালিকা জেলা প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংসদীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১ মে জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) চিঠি দিয়ে তালিকা সংরক্ষণের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ওই বছর ২৮ আগস্ট আবারও তালিকা পঠানোর জন্য তাগিদ দিয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়। ৬৪ জেলার মধ্যে ১৯ জেলা থেকে ৩৯৯ জনের একটি তালিকা আসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। 

অনেক জেলায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস নেই বলেও জানানো হয়। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করে রাজাকার, আলবদর ও আলশামসের তালিক প্রণয়ন কমিটি। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নিজস্ব উদ্যোগে জেলায় জেলায় চিঠি দিয়ে রাজাকারদের তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা করে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া উদ্যোগে তেমন কোনো সাড়া মেলেনি।

২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ১০ হাজার ৭৮৯ জন রাজাকারের নামের তালিকা প্রকাশ করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। তালিকায় নানা ধরনের অসংগতি থাকায় সেই তালিকা কয়েকদিনের মাথায় বাতিল করা হয়। গত ২৯ আগস্ট রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীসহ স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির আইন জাতীয় সংসদে পাশ হয়। ওই আইনে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত যারা মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্য হিসাবে বা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল বা আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য হিসাবে সশস্ত্র যুদ্ধে নিয়োজিত থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে বা খুন, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগের মতো অপরাধমূলক ঘৃণ্য কার্যকলাপের মাধ্যমে নিরীহ মানুষকে হত্যার মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত করেছে অথবা একক, যৌথ বা দলীয় সিদ্ধান্তে প্রত্যক্ষ, সক্রিয় বা পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, তাদের নামের তালিকা প্রণয়ন করা হবে।

Leave a Comment

error: Content is protected !!