শ্রমজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে-গোপাল অধিকারী

শ্রমজীবীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে-গোপাল অধিকারী। শনিবার মহান মে দিবস। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে গৌরবময় ইতিহাস সৃষ্টির দিন। দিনটি শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের চরম আত্মত্যাগে ন্যায্য অধিকার আদায়ের এক অবিস্মরণীয় দিন।

গত বছরের ন্যায় এ বছরও শ্রমিক দিবস যখন এসেছে, তখন মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে সারা বিশ্বে কোটি শ্রমিক কর্মহীন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই মে দিবস পালিত হয় তবে এবছর দিবসটি হোক ভিন্ন উপায়ে। কর্মহীন শ্রমজীবী পরিবারের পাশে থাকাই হোক এই বছরের প্রতিপাদ্য।

মে দিবসের ইতিহাস থেকে জানা যায়, শিল্পবিপ্লব পরবর্তী সময়ে ইউরোপ-আমেরিকার কারখানাগুলোতে নিজেদের ইচ্ছেমতো শ্রমিকদের কাজ করাতেন মালিকরা। এমনকি তাদের ন্যায়সংগত শ্রমের মূল্যও দেওয়া হতো না। এসবের প্রতিবাদে আন্দোলনে নামে শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন। ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দেন শ্রমিকরা। এতে সাড়া দিয়ে শিকাগো শহরের হে মার্কেটে জড়ো হন লাখো শ্রমিক। শ্রমিক বিক্ষোভের একপর্যায়ে পুলিশ গুলি চালালে ১০ জন শ্রমিক প্রাণ হারান।

এ ঘটনায় আহত ও গ্রেপ্তার হন আরো বহু শ্রমিক। পরে প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে গ্রেপ্তারকৃত শ্রমিকদের মধ্যে ছয়জনকে ফাঁসি দেওয়া হয়। এতে বিক্ষোভ আরো প্রকট আকার ধারণ করলে সারাবিশ্বে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।

পরে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়ে ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

১৮৯০ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ‘মে দিবস’ হিসেবে পালন করতে শুরু করে।
পরিবেশ দুই প্রকার। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সামাজিক পরিবেশ। বিভিন্ন কারণেই দুই পরিবেশ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। সেই ধারাবাহিকতায় আমার কাছে কর্মের পরিবেশও দুই প্রকার। মালিক ও শ্রমিক। সঙ্গত কারণেই মালিক ও শ্রমিক একে অপরের উপর নির্ভরশীল। তবে বিভিন্ন কারণেই শ্রমিকদের সাথে মালিকের বৈষম্যের নীতি প্রতিবেদন হয়ে উঠে।

কর্মী ছাঁটাইয়ের প্রতিবাদ ও চার মাসের বকেয়া বেতন পরিশোধের দাবিতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ১৬ মার্চ বিক্ষোভ করেছেন পোশাকশ্রমিকরা। মঙ্গলবার সকাল পৌনে ৯টার দিকে দুটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা তিব্বত মোড়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। পরে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেয়। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া শ্রমিকরা স্টিচওয়েল ও অ্যাপারেল স্টিচ কারখানায় কাজ করেন।

বৃহস্পতিবার (৮ এপ্রিল) বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ভার্সেটাইল এ্যাটেয়ার্স লিমিটেডের প্রায় ২৫০ জন শ্রমিক ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভারের ফুলবাড়িয়া এলাকায় সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। পরে পুলিশ এসে শ্রমিকদের বুঝিয়ে সড়িয়ে নিয়ে সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক করে।

শ্রমিকদের কথায় জানা যায়, গত ৩১ মার্চ শ্রমিকদের অগোচরে ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের বেতন-ভাতা না দিয়ে মালিক কারখানা বন্ধ করে দেন। পরে বিষয়টি নিয়ে শিল্প পুলিশ-১ এ অভিযোগ দিলে সেখানে শ্রমিকদের নিয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় বৃহস্পতিবার (৮ এপ্রিল) মাসের বেতন দেওয়া হবে। সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক শ্রমিকরা কারখানায় আসলে কারখানা কর্তৃপক্ষ থেকে জানানো হয় বেতন-ভাতা প্রদান করা হবে না।

বিষয়টি জানতে পেরে শ্রমিকরা ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে নেমে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করে। শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করায় সড়কের দুই পাশে প্রায় ছয় কিলোমিটার যানজটের সৃষ্টি হয়। কিন্তু একজন শ্রমিক যে একজন মালিকের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা সহজেই অনুমান করা যায় যখন শ্রমিক সংকট দেখা যায়। শ্রমিক ও মালিকের ঐক্য ছাড়া সোনার বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তাইতো ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, সোনার বাংলা গড়ে তুলি’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দেশে পালিত হয়েছে মহান মে দিবস।

সমাজে সকলেরই গুরুত্ব রয়েছে। শ্রমজীবী মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল উৎপন্ন করছে। তাদের সেই কষ্টের ফলেই আমরা খাদ্যে স্বয়ংসমপূর্ণতা অর্জন করছি। সুতরাং তাদের খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণির ইংরেজি বইয়ে একটি অনুচ্ছেদ পড়লাম। অনুচ্ছেদটা এমন সেখানে বুলবুল নামের একটি ছেলে প্রতিদিন একটি গ্রামের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করত। প্রতিদিন গ্রামের মানুষ ময়লা-আর্বজনা বাড়ির সামনে রেখে দিত। বুলবুল সকালে এসে তা বস্তায় করে নিয়ে যেত। বুলবুল তার কাজকে ছোট করে দেখত না।

কিন্তু বিদ্যমান সমাজের অনেকে ভাবত বুলবুল কেন এই পেশা বেছে নিল? এটি একটি নোংড়া পেশা। কিছুদিন পর বুলবুল অসুস্থ হলো। প্রায় সাতদিন বুলবুল এই কর্মে আসতে পারে নি। তখন দেখা গেল বাড়ির পাশে সকলের ময়লার স্ত’প জমে গেছে। দুর্গন্ধ বইতে থাকে বাতাসে। তখন সকলেই উপলব্ধি করে সমাজে বুলবুলের কাজটিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সমাজেও তেমনি মালিকের অর্থ থাকলেও যদি শ্রমিক না পান তাহলে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে না। তাই শ্রমিক-মালিক আন্তরিকতা জরুরী।

আমাদের প্রত্যেকের প্রথম পরিচয় মানুষ। এই পরিচয়ই আমাদের সকলের একমাত্র পরিচয় হওয়া উচিত। কারণ আমাদের সকলের জন্ম, রক্ত ও মৃত্যুর একই স্বাদ আস্বাদন করতে হয়। তাই ব্যক্তিজীবনে কারো সম্মান ও গুরুত্ব কম নয়। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে। কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই নিয়ে সকলের মন্তব্য কিন্তু এক রকম নয়। কেউ হয়ত ভাবছি মাথা থেকে বুদ্ধি বের হয় সুতরাং মাথাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেউ ভাবছি হাত দিয়ে সব কাজ করি তাই হাতটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আবার কারো মতে পা আমাদের শরীরকে বহন করে সুতরাং পা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু কার্যত সকল অঙ্গের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ আপনি খাওয়া বন্ধ দিন দেখুনতো কোন অঙ্গের স¦ক্রিয়তা বজায় থাকে কি না?

দীর্ঘ বঞ্চনা ও শোষণ থেকে মধ্য দিয়ে দৈনিক কাজের সময় ৮ ঘণ্টা প্রতিষ্ঠিত হয়। ‘বাংলাদেশের মতো শ্রমনিবিড় উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে পারস্পরিক সমঝোতা ও হৃদ্যতা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজীবন মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করেছেন।

বাংলাদেশ শ্রমিককল্যাণ ফাউন্ডেশন (সংশোধন) আইন ২০১৩’ ও বিধি, জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি, জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য ও সেফটি নীতিমালা এবং গৃহকর্মী সুরা ও কল্যাণনীতি প্রণয়ন করেছে। শিল্পকারখানায় বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে সার্বিক নিরাপত্তা সন্তোষজনক রাখার লক্ষ্যে মানসম্মত ও যথাযথ পরিদর্শন ও মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করেছে।

গ্রাম প্রধান বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। শ্রমজীবী মানুষই দেশের অন্যতম সম্পদ। মহান মে দিবসের এই দিনে চলমান সংকটে কর্মহীন, খেটে খাওয়া, শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের পাশে দাঁড়ানো সমাজের সকল বিত্তবান ও স্বচ্ছল মানুষদের প্রয়োজন। একই সাথে করোনা সংকটের এই সময়ে শ্রমিকদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি ও সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মতো নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য শিল্পমালিকদের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।

বিশেষ করে দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থে এই সময়ে যেসকল শ্রমিক ভাইবোন জরুরি সেবা ও কাজে নিয়োজিত রয়েছে তাদের স্বাস্থ্যনিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা বিভিন্ন সময়ে প্রতিবেদনে দেখি কৃষক তার ন্যায্য মজুরী পাচ্ছে না। রাস্তায় ধান লাগানো হচ্ছে প্রতিবাদ হিসেবে। দেখি ন্যায্য মজুরীর দাবিতে কর্মবিরতী পালন করছে গার্মেন্টস নারীরা। সামাজিক ও আর্থিক উভয় ক্ষেত্রেই শ্রমজীবীদের অবদান ও গুরুত্ব রয়েছে। তাই শ্রমজীবীদের উভয় সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমজীবীদের সুরক্ষা দেওয়ায় হোক মে দিবসের তাৎপর্য্য।

লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

Leave a Comment

error: Content is protected !!