সমতা কি তবে সোনার হরিণ

সমতা কি তবে সোনার হরিণ। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীর চিরায়ত লড়াই কোনো নির্দিষ্ট সমাজ, রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়—এটা আন্তর্জাতিক সংগ্রাম, বিশ্বজনীন লড়াই। পৃথিবীর সবখানে নারীকে লড়তে হয় সমতার জন্য, অধিকারের জন্য। আর সেই সঙ্গে অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। এটি যেন সব দেশের, সব সমাজেরই একটা অনিবার্য অংশ।

জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে এ ইস্যুটিকে বিবেচনা করা হয়েছে। জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার পর আধুনিক রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব ছিল নারীর অধিকারের প্রশ্নটি আন্তর্জাতিকভাবে জাতিসংঘসহ অন্যান্য ফোরামে যথাযথভাবে তুলে ধরা এবং এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু কাজটি ঠিকভাবে হয়নি। অথচ জাতিসংঘ একসময় আন্তর্জাতিক নারী দশক পালন করেছে, সিইডিএডব্লিউ সনদ গৃহীত হয়েছে। এ সবও একধরনের অগ্রগতি বটে।

গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশন হয়ে গেছে। বাংলাদেশসহ ১৯২টি রাষ্ট্র অংশ নিয়েছিল সেই অধিবেশনে। সঙ্গে ফিলিস্তিন ও ভ্যাটিকানের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। এতগুলো রাষ্ট্রের নেতারা সেখানে একসঙ্গে জড়ো হয়েছেন, গুরুত্বপূর্ণ সব বক্তৃতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে কয়জনকে আপনি নারীর অধিকারের প্রশ্নটি যথাযথভাবে আলোচনা করতে দেখেছেন? বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট লুইস আলবার্তো আরসে ছাড়া আর কাউকে তো আমি খুব তাৎপর্যপূর্ণ কিছু বলতে দেখলাম না।

সংবাদমাধ্যম এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ভাষ্যকারদের মধ্যেও খুব বেশি কাউকে দেখা যায়নি নারীর প্রসঙ্গটি আলোচনা করতে। আমাদের দেশসহ পুরো পৃথিবীর সংবাদমাধ্যম তেমন উল্লেখযোগ্য আলোচনা করেনি বিষয়টি নিয়ে। এর অর্থ হতে পারে একটাই—পুরো বিশ্ব আজ সন্দেহাতীতভাবে পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে পরিণত এবং ফলে নারীর অধিকার এখানে পার্শ্বরেখার বাইরে কেবল একটি হিতকারী প্রসঙ্গে পরিণত হয়েছে।

বলিভিয়ার প্রেসিডেন্টকে এখানে প্রশংসা করতেই হয়। প্রেসিডেন্ট লুইস আরসে তাঁর বক্তৃতায় বিশ্বে বিরাজমান নানা সমস্যাকে পুঁজিবাদ-সৃষ্ট সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে প্রতিটি সমস্যার জন্য সুনির্দিষ্ট করে কয়েক দফা প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। সেই সব প্রস্তাবের মধ্যে দ্বাদশ দফাটি ছিল নারীর অধিকারের জন্য প্রস্তাব। নারীর অধিকার প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট লুইস আরসে স্পষ্ট করেই বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী নারীর প্রতি বৈষম্য ও নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে; বিশেষ করে আদিবাসী নারী ও বালিকারা, যারা অপেক্ষাকৃত বেশি দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে এবং সংখ্যাগুরুর তুলনায় বেশি হারে সহিংসতা, নির্যাতন ও বৈষম্যের শিকার হয়।

ফলে ওদের জন্য এবং সার্বিকভাবে সব নারীর জন্য জাতিসংঘের বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণের দাবি করছি।’ সুনির্দিষ্ট করে তিনি দাবি করেন যে জাতিসংঘ যেন একটি দশক নির্দিষ্ট করে দেয় পিতৃতন্ত্রের অবসানের লক্ষ্যে। একদম সঠিকভাবেই তিনি তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্ট করে বলেন, পুঁজিবাদ ও পিতৃতন্ত্র হাতে হাত ধরে পরস্পরকে রক্ষা করে। সুতরাং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পিতৃতন্ত্রের চূড়ান্ত বিনাশ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।

বলিভিয়ার প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এ রকম প্রস্তাব আমাদের বিস্মিত করে না। আমাদের কেবল মনে করিয়ে দেয় যে বলিভিয়ার রয়েছে নারীর অধিকার আদায়ের জন্য গৌরবজনক সংগ্রামের ইতিহাস। ডমিটিলা চুঙ্গারার কথা আপনাদের মনে থাকার কথা। বলিভিয়ার প্রত্যন্ত আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকায় খনিশ্রমিকদের নেতা ছিলেন তিনি। বলিভিয়ায় তখন সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে খনিশ্রমিকেরা নিজেদের ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন। নিদারুণ দারিদ্র্য ও শোষণ-নির্যাতনের মধ্যে সেখানকার নারীদের আন্দোলন-সংগ্রামে অংশ নেওয়ার অধিকারও ছিল সীমিত।

ডমিটিলা চুঙ্গারা ও তাঁর সহযোদ্ধাদের তখন লড়তে হচ্ছিল একদিকে শোষণ ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, অন্যদিকে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। অসীম সাহসী আর সংগ্রামী দিনগুলোতে ডমিটিলা চুঙ্গারার নেতৃত্বে বলিভিয়ার নারীরা ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার আদায় করে নেন। আর সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সব কর্মসূচি করে আদায় করে নেন তাঁদের ন্যায্য অধিকার। আমরা যে বলি নারীকে সব সময়ই লড়তে হয়েছে দুটি আলাদা ফ্রন্টে। একটি নারী-পুরুষ একসঙ্গে শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, অন্যটি পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে একান্তই নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। এ কথাটির প্রকৃষ্ট উদাহরণ ছিল বলিভিয়ার সেই সময়ের আন্দোলন-সংগ্রামের ঘটনাবলি।

নারীবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় তরঙ্গের মুখে ১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ উদ্‌যাপন করে আন্তর্জাতিক নারী দশক। সে উপলক্ষে মেক্সিকোর আলোচনায় ডমিটিলা চুঙ্গারা তুলে ধরেন নারীর অধিকারের প্রকৃত রূপ—নারীর অধিকার কেবল বিত্তশালী নারীদের জন্য অধিকারের দাবি নয়, লোকদেখানো নয়; বরং নারী অধিকার মানে হচ্ছে প্রকৃত সমতা, অর্থনীতিতে, লড়াইয়ে—সর্বত্র।

সেই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাতেই বলিভিয়া নিজে গ্রহণ করেছে পিতৃতন্ত্র বিনাশের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কর্মসূচি। আর সেখানকার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক সভায় এসে প্রস্তাব করেন পিতৃতন্ত্রের বিনাশের জন্য জাতিসংঘ দশকব্যাপী একটি কর্মসূচি গ্রহণ করুক। বলিভিয়ার প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাব জাতিসংঘের বেশির ভাগ দেশ খুব একটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেনি। বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমগুলোও তো পিতৃতন্ত্রের পক্ষে। ওরাও বলিভিয়ার এই প্রস্তাব খুব গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেনি।

ফলে আমরা বিস্তারিত জানি না, এই প্রস্তাব নিয়ে আদৌ অধিকতর কোনো আলোচনা হয়েছে কি না। কিন্তু তারপরেও এ কথা বলতেই হয় যে লুইস আরসের এই প্রস্তাব দুনিয়ার সব দেশের নারী অধিকারের পক্ষে ক্ষীণ হলেও একটা দিকনির্দেশনামূলক কর্মসূচির সূচনা করতে পারে। ইরানসহ পৃথিবীর নানা জায়গায় চলমান নারী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এ রকম একটা কর্মসূচি কেবল নারীদের জন্যই নয়, গোটা মানবসমাজের জন্যই জরুরি।

১৯৭৫ সাল থেকে জাতিসংঘ উদ্‌যাপন করে আন্তর্জাতিক নারী দশক। সে উপলক্ষে মেক্সিকোর আলোচনায় ডমিটিলা চুঙ্গারা তুলে ধরেন নারীর অধিকারের প্রকৃত রূপ—নারীর অধিকার কেবল বিত্তশালী নারীদের অধিকারের দাবি নয়, বরং নারী অধিকার মানে হচ্ছে প্রকৃত সমতা, অর্থনীতিতে, লড়াইয়ে—সর্বত্র।

ইমতিয়াজ মাহমুদ
আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট

Leave a Comment

error: Content is protected !!