সুখী হতে আমিত্ব থেকে মুক্তি প্রয়োজন

সুখী হতে আমিত্ব থেকে মুক্তি প্রয়োজন। পৃথিবীর সব থেকে উপদ্রবকারী শব্দ হচ্ছে ‘আমি’। কারণ এই ‘আমি’টা তখন মনে করে, আমাকে কেন্দ্র করেই তো সব। ‘আমি’ই মধ্যমণি। ‘আমি’ তখন হয়ে যায় ‘প্রত্যাশা’!

এখন প্রশ্ন হলো—কীভাবে? উত্তরটা সহজ—আমিই যখন সব, তখন আমরা অন্যের ভুল ধরতে ব্যস্ত থাকি! মনে করি, ওর উচিত আমাকে বা আমার সঙ্গে এমন ব্যবহার করা, এভাবে ভালোবাসা, এভাবে মোকাবিলা করা, এভাবে সম্মান করা, পরীক্ষায় এত নম্বর দেওয়া, এটা না দেওয়া, সেটা দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।

এই ‘আমি’টা কিন্তু অত্যন্ত উচ্চমাত্রার প্রত্যাশা নিয়ে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত পার করছে! এই ‘আমি’র চারপাশে তাহলে কী আছে? চারপাশের পৃথিবীভর্তি শুধু আমার মতামত, আমার সিদ্ধান্ত, আমার ইচ্ছা, আমার অনিচ্ছা, আমার পছন্দ, আমার অপছন্দ, আমি এটা ভালোবাসি, আমি সেটা চাই, আমি এটা চাই না—এই ভাবনাগুলো! আমি, আমি আর আমিই শুধু প্রতিধ্বনিত হয় ইথারে। এটাই আমিত্ববাদ! আপনি কি মনে করেন একজন মানুষের এই আমিময় জীবনটি খুব আনন্দের?

নিজের চোখে একটু আয়না ধরুন তো; কল্পনা করুন জীবনটা শুধু আমার চারপাশের ‘আমি’কে কেন্দ্র করেই পাক খাচ্ছে! আর কোথাও কেউ নেই। এ রকম একটা জীবন নিঃসঙ্গ। এই ‘আমি’টা তখন একদম একা কিন্তু। ‘আমি’টা টেবিলের একদিকে বসছে। বাকি সারা পৃথিবী টেবিলের উল্টো দিকে। আর এই নিঃসঙ্গতর ‘আমি’ কেবল চাইছে, আমাকে দাও, দাও, দাও! কী ভয়ানক একাকিত্ব ভাবা যায়! স্বস্তি কই?

অথচ এভাবেই আমাদের ছোটবেলা থেকে বড় করা হয়েছে। মনস্তত্ত্বের ভাষায় একে সোশ্যাল কন্ডিশনিং বলে। অবচেতনভাবে আশৈশব আমরা শুধু ক্রমাগত চেয়েছি আর নিতেই শিখেছি। আজ এটা, কাল সেটা। শুধু চাই চাই, আর পাই নাই পাই নাই গল্প।

ফলে অবচেতনভাবে এই ‘আমি’টা বিশ্বাস করি অন্যরা আমার (!) চাহিদা মোতাবেক, আমার (!) প্রত্যাশা পূরণ করবে, সবকিছু আমার (!) চাহিদামতো হবে! যে আমার (!) সঙ্গে তাল মেলাতে পারবে না, সে বাদ। আমরা দল বানাতে শুরু করি।

ঠিক এভাবে বিয়ে, সন্তান, প্রেম, আন্তসম্পর্কের ব্যাকরণ, বন্ধুত্ব, পেশাগত সম্পর্ক ইত্যাদি সবই ‘আমার’ প্রত্যাশার মাপকাঠিতে স্থির হবে; এটাই আমাদের অবচেতন মনের চাহিদা। এর ব্যত্যয় ঘটলেই যত বিবাদ, বিসংবাদ, বিতর্ক! সব কি পাওয়া সম্ভব—সচেতন মন যুক্তির খাতিরে একটু প্রশ্ন তুললেও অবচেতন হা হা করে তেড়ে আসে। অবচেতন মন মানে না।

আপনি কি মনে করেন আমরা ধর্মকেও এই ‘আমিত্ব’ থেকে রেহাই দিয়েছি? আমরা যদি ছোট বাচ্চাদেরই রেহাই না দিই, তাহলে ধর্ম কোন ছার! একটা উদাহরণ দিই। ধরুন, একজন মানুষ যখন উপাসনায় বসেন, তখন শুধু স্রষ্টার কাছেই চাইতে থাকেন যে ‘আমাকে এটা দিন, সেটা দিন, এটা দেবেন না, সেটা দেবেন না!’ প্রার্থনার আলাপ শতকরা কত ভাগ ‘আমি চাই’ আর ‘আমি চাই না’তেই সীমাবদ্ধ, সেটা নিজেই একটু ভাবুন।

অথচ দিন শেষে কয়জন বলেন, ‘হে আমার স্রষ্টা! আপনি সুন্দর! আপনাকে নিঃশর্ত ভালোবাসি! আপনাকে এটা দিতে চাই, সেটা দিতে চাই, এটা নিন, সেটা নিন!’ তাই প্রশ্ন হলো, কৃতকর্মের পাপের জন্য শাস্তির বিধান না থাকলেও কি রীতিবদ্ধ সদাচরণ মানুষ করত? কয়জন মানুষ শুধু শাস্তির ভয়ে সৎকর্ম করে, সেটা মনো-আধ্যাত্মিক গবেষণার বিষয় এখানে আলোচ্য নয়।

জন এফ কেনেডি যখন প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাষণ দিতে মঞ্চে ওঠেন, তখন তিনি প্রথমেই বলেন, ‘দেশ আপনার জন্য কী করতে পারছে, সেটা জানতে চাইবেন না; বরং আপনি দেশের জন্য কী দিতে পারছেন, সেটা ভাবেন প্রথমে!’

ঠিক সেভাবে বলা যায়, মানুষ আপনার সঙ্গে কী করল সেটা ভেবে কাতর না হয়ে; বরং আপনি আপনার সীমিত সক্ষমতায় একটি মমতাময় সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিজে কী করছেন, সেটা নিজেকে জিজ্ঞেস করুন।

কিন্তু নিজের চোখে এ আয়নাটি ‘আমি’ ধরি না। কারণ ‘আমি’ শব্দটি যখন মনোজগতের ক্যানভাসজুড়ে বিশালাকার ধারণ করে, তখন আমার চাহিদা, আমার প্রত্যাশা, আমার চিন্তা, আমার ইচ্ছা, আমার অনিচ্ছা এত বড় ওঠে, এত শক্তিশালী হয়ে যায় যে আমরা স্রষ্টার সামনে মাটিতে মাথা কুটলেও নিজের মনে বারবার বলতে থাকি, ‘হে সৃষ্টিকর্তা, আমাকে এটা দিন, আমাকে সেটা দিন, আমি এটা চাই, আমি সেটা চাই, আমি, আমি, আমি।’

যত বেশি জীবনটা ‘আমি’ শব্দটা দিয়ে পরিচালিত করব, তত বেশি এই ‘আমি’ হতাশায় নিমজ্জিত হবে। কারণ পৃথিবীর মানুষ আমার প্রত্যাশা পূরণ করার জন্য বাঁচে না। তাই ‘আমি’ শব্দটি মনোসামাজিক স্বাস্থ্যের জন্য এটা অবশ্য পরিত্যাজ্য।

এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা কীভাবে এই ‘আমি’কে পরিত্যাগ করব? উত্তর হলো—প্রথমত, বাস্তবসংগত প্রত্যাশা করতে দোষ নেই, কিন্তু ‘না’ শুনতে শিখতে হবে। বাইরে মিষ্টিমুখে মেনে নিলাম, ভেতরে দল পাকালাম, তা হবে না। আর জানেন তো দুজন বাঙালি থাকলে তিনটি দল হয়। আমার দল, তোমার দল, আমাদের দল।

দ্বিতীয়ত, অন্যদের দিকে প্রকৃত (লোকদেখানো না) মমতার হাত বাড়িয়ে দিলে আমিত্ব কমে। কারণ,

■ যখন আপনি অন্যের থেকে যত্ন চাইবেন, তখন আদৌ যত্ন পাবেন কি না, বিষয়টা অন্যের ইচ্ছাধীন। কিন্তু যখন আপনি নিজে খোলামেলা, সততার সঙ্গে অন্যকে যত্ন করতে চাইবেন, তখন আপনাকে কে আটকাবে? তখন আপনার কাউকে তোয়াক্কা করার দরকার নেই।

■ আপনি যখন অন্যের কাছ থেকে মর্যাদা চাইবেন, তখন অন্য ইচ্ছা হলে দেবে, ইচ্ছা না হলে দেবে না; কিন্তু যখন আপনি অন্যকে সম্মান দেবেন, মর্যাদা দেবেন, তখন আপনাকে আটকায় সাধ্য কার?

■ যখন আপনি অন্যের থেকে ভালোবাসা, মমতা চাইবেন, তখন সেটা দেওয়া তার ইচ্ছাধীন। কিন্তু যখন আপনি নিজে ভালোবাসা, মমতা অন্যকে দেবেন, তখন কার ক্ষমতা আছে আপনাকে আটকানোর?

■ যখন আপনি অন্যের কাছে সাহায্য চাইছেন, মানুষ আপনাকে তখন সাহায্য করতেও পারে, না-ও করতে পারে; কিন্তু যখন আপনি আপনার সীমিত সক্ষমতার মধ্যে অন্যকে সাহায্য করতে চাইবেন, তখন কার দুঃসাহস আপনাকে আটকানোর?

আর ঠিক এভাবেই যাত্রা শুরু হয় আমি থেকে আমরাতে! মূলকথা হলো, মানুষ যত ‘আমি’, ‘আমি’ বলে নিজের জন্য চাইবে, তত হতাশ হবে, আর বদলে যত অন্যকে দিতে চাইবে, আনন্দ ততই বাড়বে। কারণ দিন শেষে, ‘উই আর নট ইনডিপেনডেন্ট, উই আর ইন্টারডিপেনডেন্ট।’

Leave a Comment

error: Content is protected !!