হসপিটাল ফার্মাসিস্ট নিয়োগ: স্বদেশ ও বিদেশের সেবার মানগত তফাৎ
উন্নয়নশীল বাংলাদেশের প্রতিটি সুনির্দিষ্ট সুপরিকল্পনার প্রভাব প্রতিটি জনগণের জীবনমানের উপর ন্যস্ত। একইভাবে প্রতিটি অপরিকল্পনার প্রভাব বৈরিভাবে সমগ্র জনগণের জীবনমানের উপরই ন্যস্ত। এক্ষেত্রে নীতিনির্ধারকরা মুখ্য হিসেবে কাজ করে। নীতিনির্ধারকদের প্রণীত পরিকল্পনাগুলো ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন দপ্তর থেকে তৃর্ণমূল পর্যায়ে বাস্তবায়িত হয়। অবশ্য এই ক্রমযাত্রাই সংযোজন-বিয়োজন অবশ্যই স্বীকার্য। তবে তা মুখ্য ভূমিকায় নয়। সকল পদ্ধতিগত প্রক্রিয়ার ন্যায় স্বাস্থ্যসেবার একই দশা।
থাক সে কথা। একটু বাস্তব চিত্রে কল্পনা করি, যখন আমাদের দেশের চিকিৎসালয়ের সেবা মানের প্রতি সন্তুষ্ট না হয়ে অনেকেই স্বদেশের ডাক্তারদের পরামর্শেই বিদেশের হাসপাতালের শরণাপন্ন হওয়ার ঘটনা ঘটে। তখন ক্ষুদ্র জ্ঞানে মনে প্রশ্ন জাগে, মেডিসিন, চিকিৎসা সরঞ্জাম, চিকিৎসাশাস্ত্র একই থাকার সত্ত্বেও কেন স্বদেশ ও বিদেশের সেবার মানগত এত তফাৎ?
এটা বলে রাখা ভালো যে, বাংলাদেশের মেধাবী মেধাবী ডাক্তাররা পিএইচডি করার জন্য বিদেশ পাড়ি দেয়। তখন স্বদেশ থেকে বিদেশে সার্বিক সুবিধা বিবেচনা করে বিদেশেই স্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। বিদেশের চিকিৎসালয় আমাদের দেশের মেধাবী চিকিৎসকদের দিয়ে পরিপূর্ণ হয়, অন্যদিকে স্বদেশের চিকিৎসালয় বেহাল পরিস্থিতি মুমূর্ষের ন্যায়। আমি এটা বলছি না যে, আমাদের দেশে মেধাবী চিকিৎসকদের অভাব চিকিৎসালয় বা হাসপাতালগুলোতে।
যাই হোক,বিদেশে স্থায়ী নাগরিক হওয়ার বিষয়টি ওই পিএইচডি রত মেধাবী চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবেই মেনে নিলাম। এখন আসি চিকিৎসাসেবার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে। আদর্শ স্বাস্থ্য প্রণালী ডাক্তার , ফার্মাসিস্ট ও নার্স এই তিন শ্রেণীর সমন্বয়। এখন ফার্মাসিস্টদের কথায় আসি, বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ফার্মেসি সাবজেক্ট প্রধান পছন্দনীয়। তার আগে বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিল এর ওয়েবসাইটের একটি তথ্য তুলে ধরি,বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের আওতাধীন ফার্মেসী আইন ২০১৩ (বিশেষ বিধান) এর (ফার্মেসী অধ্যাদেশ ১৯৭৬) ধারা ৪(২) ক্ষমতাবলে প্রতিষ্ঠিত ফার্মেসী শিক্ষা ও ফার্মেসী পেশার একমাত্র নিয়ন্ত্রক সংস্থা।
১৯৭৬ সালে ফার্মেসী অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ফার্মেসিকে একটি পেশাগত বিষয় এবং ফার্মাসিস্টদেরকে পেশাজীবি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বর্তমানে ১৩ টি সরকারি ও ২৮ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পর্যায়ে ফার্মেসী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ ফার্মেসী কাউন্সিল এক্রিডিটেশন প্রদান করেছে এবং এ সকল বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক সম্পন্ন করার পর ফার্মেসী কাউন্সিল পাশকৃত শিক্ষার্থীদের ‘এ’ক্যাটাগরিতে রেজিষ্ট্রেশন প্রদান করে থাকে। স্বাভাবিকভাবে মেডিকেল ও ইঞ্জিনিয়ারিং এ ক্ষেত্রে স্বদেশ-বিদেশ উভয় অবস্থানে সুবিধা রয়েছে কিন্তু ফার্মেসি বিষয়ের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন প্রকৃতির।
বলে রাখা ভালো , গ্রেজুয়েট বা “এ ” ক্যাটাগরি ফার্মাসি প্রসঙ্গে আমি বলছি । যখন একজন মেধাবী শিক্ষার্থী বি. ফার্ম ও এম ফার্ম সম্পন্ন করে তখন তার শুধুমাত্র একদিকে রাস্তা থাকে। তা হলো স্বদেশের সকল দেশপ্রেম ও মায়া জলাঞ্জলি দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো । কেননা ফার্মাসিস্টদের ব্যাপক চাহিদা ও সুবিধার মিলনস্থান বিদেশ। পক্ষান্তরে স্বদেশে ফার্মাসিস্টদের জন্য কোনো সরকারি চাকরি নেই। যদিও কিছুদিন আগে হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ শুরু হয়েছে, তবে তা অতি নগণ্য। ফার্মাসিস্টদের কদর দেরিতে উপলব্ধি করা হলেও ব্যাপারটা কিছুটা সন্তোষজনক বটে।
স্বদেশে শুধুমাত্র ওষুধ কোম্পানিগুলোতে চাকরির ব্যবস্থা রয়েছে কিন্তু তা মূলত সন্তোষজনক হতে পারে না।যে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা ফার্মাসিস্ট হিসেবে বিদেশে পাড়ি জমায়, তখন সে দেশের সেবার মানগত ভবিষ্যত কি যে হতে পারে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হতে পারে এটা শিক্ষার্থীর ইচ্ছা-অনিচ্ছায় বিদেশে পাড়ি জমানো কিন্তু তার আগে তো সরকারের নিশ্চিত করতে হবে যে ফার্মাসিস্টদের স্বদেশে সরকারি চাকরির ব্যবস্থা। স্বদেশের চিকিৎসা সেবা মান ফার্মাসিস্টবিহীন এমন যেমন চোখবিহীন মানবদেহ তেমন। এখন আসি একটি হাসপাতালে একজন ফার্মাসিস্ট এর কি ভূমিকা এবং প্রয়োজনীয়তা ।
প্রথমেই বলে রাখি, একজন হসপিটাল ফার্মাসিস্ট হসপিটালে ব্যবহৃত সকল মেডিসিন এবং সরবরাহ পর্যালোচনা করে থাকেন। কেননা একজন ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষার্থী পড়াশোনায় মূলত মেডিসিন সম্পর্কে। একজন হসপিটাল ফার্মাসিস্ট ঔষধের মান যাচাই , ডোজ পরিমাণ ঔষধ প্রস্তুত করেও থাকেন। এক্ষেত্রে ফার্মেসি টেকনিশিয়ানরা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এটা ওই হাসপাতালে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সুপরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার উপর নির্ভর।
হসপিটাল ফার্মাসিস্ট রোগীদের সাথে ওষুধ বিষয়ে তথ্য প্রদান করে থাকেন। মূলত একজন ফার্মাসিস্ট ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মতো ওষুধের পর্যালোচনা করে রোগীর সাথে মতবিনিময় করেন , রোগীকে ঐ ওষুধ সম্পর্কে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দেন। ফার্মাসিস্ট তখন রোগীর চলমান ওষুধের সাথে বর্তমান ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সহ নানান বিষয় খুঁটিনাটি সকল তথ্য যাচাই বাছাই করে ওষুধ নির্বাচন করে থাকেন। এক্ষেত্রে একজন ফার্মাসিস্ট ও রোগীর উভয়ের আন্তরিকতা বাধ্যতামূলক। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী প্রদানকৃত ওষুধ সেবনের পর থেকে ঔষধের কার্যকারীতা পর্যন্ত রোগীকে মনিটরিং করে থাকেন ফার্মাসিস্ট।
মূলত ডাক্তারের চিকিৎসার আউটপুটকালে পেতে ফার্মাসিস্টদের ভূমিকা অপরিসীম। একজন ফার্মাসিস্ট মূলত রোগীদের জন্য সঠিক রোগের সঠিক ঔষধ নিশ্চিত করেন, হসপিটালের মেডিসিন চার্ট নিয়মিত মনিটরিং করে।
ডোজেজ ফর্ম কিভাবে কতটুকু করে কোন রুটে রোগী নিবেন সব বিষয়ে রুগীকে বুঝিয়ে দেন একজন হসপিটাল ফার্মাসিস্ট।
স্বদেশে তুলনায় বিদেশেই ব্যাপারটা বেশ লক্ষণীয়। উন্নত দেশগুলোতে রোগীদের হসপিটাল থেকে ডিসচার্য করা একটা অন্যতম কাজ ফার্মাসিস্টদের। কোন রোগী কখন রিলিজ হবে, রিলিজ সামারি পর্যালোচনা করা যাতে প্রেসক্রিপসন অনুযায়ী সঠিক ঔষধ রোগীকে দেয়া হয়েছে কিনা, রোগীর কোন সাইড এফেক্ট আছে কিনা, ওষুধের কারণে কোন নতুন সাইড এফেক্ট দেখা দিয়েছে কিনা সব বিষয়ে পর্যালোচনা করার পর রোগীর রিলিজ নিশ্চিত করে থাকেন ফার্মাসিস্ট। উন্নত দেশগুলোতে একজন ফার্মাসিস্ট বিহীন হাসপাতাল নেই বললেই চলে। সেখানে রোগীর অনুপাতে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ করা থাকে। নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী সকলকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা ও তথ্য প্রদান করে থাকেন ফার্মাসিস্ট।
কোনো রোগীর কম্প্লিকেশন দেখা দিলে ফার্মাসিস্ট ডাক্তার মিলে সেই জটিলতা দূর করেন। বুঝাই যাচ্ছে যে ডাক্তার ফার্মাসিস্ট একে অপরের পরিপূরক। হাসপাতলে নকল ভেজাল ঔষধ সরবরাহের ব্যাপারে তদারকির দায়িত্ব একজন ফার্মাসিস্ট এর উপরেই ন্যস্ত। একটি হাসপাতালে হসপিটাল ফার্মাসিস্ট এর গুরুত্ব এত থাকা সত্ত্বেও আমাদের দেশে কেন হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের ব্যবস্থা চালু করা হয়না?
বিদেশে চিকিৎসা ব্যবস্থায় ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও নার্সের মাধ্যমে চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রচলিত হয়। ডাক্তার রোগীকে দেখে প্রেসক্রিপশন করেন, ফার্মাসিস্ট ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন মূল্যায়নের মাধ্যমে রোগীকে ওষুধ সম্পর্কে সম্পর্কে অবহিত করেন এবং নার্স ফার্মাসিস্টদের নির্দেশিত পন্থায় রোগীকে সেবা করেন। বলা যেতে পারে বিদেশে আদর্শ চিকিৎসাব্যবস্থা প্রণালী মেনে চলা হয় কিন্তু আমাদের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাযর প্রেক্ষাপট বেশ ভিন্ন প্রকৃতির।
রোগী প্রথমেই আসে ডাক্তারের কাছে, ডাক্তার বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা দেন, তারপর ল্যাব টেকনিশিয়ানদের মাধ্যমে পরীক্ষা করেন। রোগী প্রাপ্ত রিপোর্ট ডাক্তারকে দেখান। ডাক্তার প্রেসক্রিপশন করেন । নার্স ডাক্তারের প্রদানকৃত প্রেসক্রিপশনের ওষুধ রোগীকে সেবন করান। স্বদেশে হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের কাজটা মূলত নার্সরাই সম্পন্ন করে ফেলে। ব্যাপারটা এমন, গরুর বদলে ছাগল দিয়ে হালচাষ করে যেমন ফলন হবে বর্তমান হসপিটাল ফার্মাসিস্টবিহীন হাসপাতালের সেবার মান তেমন নাজুক হবে। মেধাবী ফার্মাসিস্ট শিক্ষার্থীদের স্বদেশে সুযোগ দিতে হবে, আমাদের দেশে নিয়োগ দিতে হবে প্রত্যেক হাসপাতলে হসপিটাল ফার্মাসিস্টদের। ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট, নার্স এই তিনের সমন্বয় পরিচালিত করতে হবে স্বদেশের চিকিৎসাব্যবস্থা।
সুপরিকল্পিত সেবানীতি নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের ডাক্তাররা রোগীর প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক ও মেধাবী। নিজের জীবন বাজি রেখে করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে , তাদের শ্রমের মূল্য দিয়ে যাচ্ছে। এই দেশের এই করোনা ক্রান্তিলগ্নে ফার্মাসিস্টদের সুযোগ দিতে হবে। ডাক্তারের সাথে সহযোগিতা করে রোগীদের সেবা দেওয়ার সুযোগ ফার্মাসিস্টদের দিতে হবে। তাহলে বোধ করি হাসপাতলে সেবার মানগত উন্নতি হবে। আমরা কখনোই চাই না, কেউ স্বদেশ ছেড়ে বিদেশী চিকিৎসার শরণাপন্ন হোক। আমরা চাই, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার মানগত পরিবর্তন করার ঐক্যবদ্ধতা সৃষ্টি হোক আমাদের শিরা-উপশিরায়।
লেখক ও কলামিস্ট
শেখ সায়মন পারভেজ হিমেল