বাংলাদেশের ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এবং বর্তমান ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলীর কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেন প্যালেসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সভাপতি ছিলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

পরবর্তীকালে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্মনিরপেক্ষ তার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে পরে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়; নাম রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার ‘মুকুল’ প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাঁকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দলটি প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সে নির্বাচনের পর বিজয়ী শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করে। এর জের ধরে শুরু হওয়া তীব্র রাজনৈতিক সংকট শেষ পর্যন্ত গড়ায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। যার পরিসমাপ্তি ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন এই সরকারের অধীনে দীর্ঘ ৯ মাস অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে বাঙালি জাতি। প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্নের ফসল স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ। মুক্তির সেই ক্ষণেরও প্রায় এক মাস পর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। মুক্ত দেশের মাটিতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পা রাখেন জাতির পিতা। ১২ জানুয়ারি বঙ্গভবনে বিপুল করতালি, জয় বাংলা ও বঙ্গবন্ধু ধ্বনির মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ এ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্বিতীয়বারের মতো শপথ নেন শেখ হাসিনা। ৫ জানুয়ারি ২০১৪ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো শপথ নেন শেখ হাসিনা। ২৯ ডিসেম্বর ২০১৮ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো শপথ নেন।

আমি ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ছাত্রলীগ থেকেই শহিদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের জিএস নির্বাচিত হয়েছিলাম। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমার যাত্রাবাড়ীর বাড়ি থেকেই ঢাকার পূর্বাঞ্চলের (তেজগাঁও, ডেমরা-শ্যামপুর-যাত্রাবাড়ী) আওয়ামী লীগের যাত্রা শুরু হয়। বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক ও বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমার নেতা, আমার রাজনীতির হাতে খড়ি তাঁর হাতে। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার অজস্র স্মৃতি। তার আমৃত্যু সংগ্রাম, অমিত সাহস, অতুলনীয় অর্জন ও উদাহরণযোগ্য ত্যাগের কথা আমাকে সর্বদা ভাবায়।

বঙ্গবন্ধুর সময়ে আমি ছিলাম ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর আমরা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বরের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। পূর্বের ন্যায় বঙ্গবন্ধুর মধ্যে সেদিনও ছিল খুব প্রাণচাঞ্চচলতা। বঙ্গবন্ধুর কখনোই ভাবেনি তার করা স্বাধীন বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর ঘাতকরা তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের ওপর নির্যাতন চালায়। আমাকে হত্যা করার জন্য কয়েকবার আমার বাড়িতে আক্রমণ চালায়। তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আমাকে ছয় মাস আত্মগোপনে থাকতে হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল। তারা ইতিহাস থেকে আওয়ামী লীগের নাম মুছে ফেলতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন কেউ বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে মুছতে পারবে না।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। এ সময় বিদেশে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ডাক আসে দেশমাতৃকার হাল ধরার। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনো কিছুই তাকে তার পথ থেকে টলাতে পারেনি এক বিন্দু। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে শেখ হাসিনার প্রথমবারের শাসনকাল চিহ্নিত হয় স্বর্ণযুগ হিসেবে।

২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি দ্বিতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তিনি। গঠিত হয় মহাজোট সরকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন দেশে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা এবং শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে রেকর্ড সৃষ্টি করে তিনি চতুর্থবারের মতো দেশ পরিচালনার সুযোগ পেয়েছেন। তার গৃহীত পদক্ষেপে দেশবাসী আজ তার সুফল পাচ্ছে। অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে।

এক বর্ণাঢ্য সংগ্রামমুখর জীবন শেখ হাসিনার। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস তিনি গৃহবন্দি থেকেছেন। সামরিক স্বৈরশাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারানির্যাতন ভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। বারবার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে। অন্তত ১৯ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও তিনি অসীম সাহসে তার লক্ষ্য অর্জনে থেকেছেন অবিচল।

একজন সফল রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে শেখ হাসিনার অবদান আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। ইতিমধ্যে তিনি শান্তি, গণতন্ত্র, স্বাস্থ্য ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নয়ন এবং দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য ভূষিত হয়েছেন মর্যাদাপূর্ণ অসংখ্য পদক, পুরস্কার আর স্বীকৃতিতে। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।

লেখক:
আর কে চৌধুরী
মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ,
মহান মুক্তিযুদ্ধে ২ ও ৩ নং সেক্টরের রাজনৈতিক উপদেষ্টা।

Leave a Comment

error: Content is protected !!