সেই ছাত্রলীগ গেল কোথায়?

সেই ছাত্রলীগ গেল কোথায়? বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একটি বিশাল গৌরবের ইতিহাস আছে। দেশের জন্মলগ্ন ও ক্রান্তিকালের নানা সংগ্রামে অগ্রবর্তীদের তালিকায় থেকে এ গৌরব অর্জন করেছিল ছাত্রলীগ। গৌরব থাকলে কালিমা লাগার আশঙ্কা থাকে। কালিমা থেকে দূরে থাকতে দরকার দক্ষ রাজনৈতিক সদিচ্ছার। ছাত্রলীগ সম্ভবত সেটি ভুলে গেছে।

দেশভাগের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় ছাত্রলীগ। সেই থেকে সংগ্রামে, বিপ্লবে, আন্দোলনে ও যুদ্ধে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে ছাত্রলীগের নাম জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে।

১৯৫২ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ভাষার দাবিতে মিছিল করা, ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টকে মাঠে থেকে সমর্থন দেয়া, ১৯৬২ সালে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন, ১৯৬৯ এ গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ ও সবশেষে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছিল অগ্রগণ্য।

কিন্তু বর্তমান ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে ফিকে হয়ে যাচ্ছে অতীতের সব সোনালি ইতিহাস। যে ছাত্রলীগ দেশের জন্য রক্ত দিতে ছিল সদাপ্রস্তুত, কালক্রমে সেই ছাত্রলীগ হয়ে উঠেছে রক্তপিপাসু। খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, যৌন হয়রানি, দুর্নীতি হেন কোনো অপরাধ নেই যা ছাত্রলীগ করেনি। বারবার শোধরানোর কথা বলে আসলেও তা যে কেবল ফাঁকা বুলি, ছাত্রলীগের গত দুই দশকের কর্মকাণ্ডই এর সাক্ষাৎ প্রমাণ।

সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় আবারও শিরোনামে ছাত্রলীগ। শেষ কবে ছাত্রলীগ ভালো কাজে শিরোনামে এসেছে তা খুঁজে বের করা কষ্টসাধ্য হলেও ছাত্রলীগের অপকর্মের সংবাদ পত্রিকার পাতায় জায়গা করে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

ছাত্রলীগের অপকর্মের শাস্তি হালকা ‘শাসন’ ও এর ফলাফল এখন চাক্ষুষ। সতের মাস আগেও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে মাহাদি জে আকিব নামে এক শিক্ষার্থীর মাথার খুলি থেঁতলে দেয়ার ঘটনায় আলোচিত হয়েছিল সারা দেশে। নিজের সহপাঠীর মাথার খুলি থেঁতলে দিয়ে আলোচনায় আসেন একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগ নেতা অভিজিৎ দাশ। সে সময় শাস্তি হিসেবে তাকে দুবছরের জন্য বহিষ্কার করা হলেও ফিরে এসে এবার অভিজিৎ ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আবারও জড়িয়ে পড়েন ছাত্র নির্যাতনের মতো অপকর্মে।

৮ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের চার শিক্ষার্থীকে ডেকে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতন করে ছাত্রলীগের অভিজিৎ বাহিনী। টর্চার রুমে চার জনকে সারারাত পেটানো হয় লোহার রড ও খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে। এদের মধ্যে দুজন ইতোমধ্যে মৃত্যুভয়ে ছেড়েছেন ক্যাম্পাস ও বাকি দুজন মারের ধকল সইতে না পেরে ভর্তি হয়েছেন আইসিইউতে। তবে আইসিইউতে গিয়েও আহতদের হুমকি দিয়েছেন অভিজিৎ বাহিনীর সদস্যরা। অপরাধের জন্য অনুতপ্ত হওয়া দূরের কথা, দম্ভের সঙ্গে আহতদের হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘এখন আইসিইউতে আছিস, নাম বললে মর্গে থাকবি!’

একই ধাচের ঘটনা ঘটেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে এক সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাত্রকে হলরুমে আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে একই হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নাঈম ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. সোলাইমান ও তাদের অনুসারীরা। শুরুতে তাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে পেটানো হলেও পরে যখন জানা যায় সে সনাতন ধর্মাবলম্বী তখন সংখ্যালঘুতার সুযোগ নিয়ে তাকে আরেক দফা পেটানো হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী কৃষ্ণ রায় জীবনের নিরাপত্তা জানিয়ে  বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ও হল প্রাধ্যক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

তবে অভিযোগের জায়গায় থেকে যায় অভিযোগ, অপকর্ম চালিয়ে যায় ছাত্রলীগ। এর আগেও চলতি বছর ১৯ জানুয়ারি শাহ মাখদুম হলের সামিউল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর ও টাকা ছিনিয়ে নেয়া, ২২ জানুয়ারি শহীদ শামসুজ্জোহা হলের জাকির হোসেন নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করে তার নিজের কক্ষ থেকে বের করে দেয়াসহ একই রকমের নানা অপরাধ ও নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে আসছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা।

বৃহস্পতিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি-২৩) ছাত্রলীগের এসব অত্যাচারের প্রতিবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্বোহা চত্বরে প্রতীকী অনশনে বসেছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান। দেশজুড়ে ছাত্রলীগ সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর একের পর এক যে নিপীড়ন আর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, যা রীতিমতো মানবাধিকার লঙ্ঘন উল্লেখ করে ফরিদ উদ্দিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত তার প্রতীকী অনশন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এদিকে ১২ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে শেখ হাসিনা হলের একটি কক্ষে আটকে রেখে বিবস্ত্র করে নির্যাতন ও ভিডিও ধারণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরী অন্তরা ও তার সহযোগীরা। ভুক্তভোগী ছাত্রী জানান, গণরুমে নিয়ে তাকে চড়, লাথি, ঘুষি মেরে বিবস্ত্র করা হয়। রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত তার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। পরদিন ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে নিজ গ্রামে পালিয়ে গেলেও অভিযুক্তরা রয়ে গেছেন ক্যাম্পাসে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি কোনো ব্যবস্থা।

ছাত্রলীগের রক্ষাকবচ ‘শিবির’ ট্যাগ

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে শো-ডাউনের রাস্তা ও হলগুলোকে টর্চার শেল বানিয়েছে ছাত্রলীগ। যখন তখন ছাত্র তুলে এনে পেটানো যেন পরিণত হয়েছে তাদের বিনোদনের খোরাকে। ছাত্র পিটিয়ে তাদের শিবির ট্যাগ দিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়ার ঘটনা ছাত্রলীগের নেতাদের কাছে এক রকমের ডাল-ভাত।

গত ২০১৯ সালে ৭ অক্টোবর আলোচিত বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদকে একইভাবে শিবির ট্যাগ দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছিলেন বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এদের মধ্যে ২০ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

আবরার হত্যার পর বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও দেশের যে কয়টি বিদ্যাপিঠে আছে ছাত্র রাজনীতি সবকটিতে দেখা যায় ছাত্রলীগের দাপট।

স্বাধীনতার আগে যে ছাত্রলীগ ছিল শিক্ষার্থীদের কাছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মূর্তি ও স্বস্তির জায়গা, স্বাধীনতার পরে ধাপে ধাপে সে ছাত্রলীগ হয়ে উঠছে অপরাধীদের অভয়ারণ্য।

অবৈধভাবে হল দখল, ক্যাম্পাসে বিশৃঙ্খলা, ক্যান্টিনে খাবারের বিল না দেয়া, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে এক সময়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের দাবিদার ছাত্রলীগ।

ক্যাম্পাসে কোনো শিক্ষার্থীর আচারণ মনঃপুত না হলে তাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে পেটানো, নিজেদের টর্চার শেলগুলোতে শিক্ষার্থীদের ডেকে নিয়ে নির্যাতন করা, ক্যাম্পাসে একই ছাত্রলীগের দুগ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ রূপ নিয়েছে ছাত্রলীগের প্রতিদিনকার ঘটনায়।

প্রশ্নফাঁস, সিট বাণিজ্য ও দুর্নীতি

২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের মতো গর্হিত কাজে জড়িয়ে আছে ছাত্রলীগের নাম। সে সময়ে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হল থেকে ছাত্রলীগ নেতা মহিউদ্দিন রানা এবং অমর একুশে হল থেকে আবদুল্লাহ আল মামুনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

পরবর্তীতে ২০১৯ সালে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) দেয়া অভিযোগপত্রে দেখা যায়, প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ আনা ১২৫ জনের মধ্যে ২১ জন ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মী।

এ ছাড়া ইডেন কলেজের ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে আছে সিট বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির নানা ধরনের অভিযোগ। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তাদের কমিটি স্থগিত করা হয়েছিল কয়েকবার। কিন্তু ঘুরে ফিরে একই অপকর্মে বারবার শিরোনামে এসেছে এই প্রতিষ্ঠানটির ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের নাম।

এরমধ্যে একটি দেশীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নাহিয়ান-লেখক কমিটির দুর্নীতি নিয়ে সৃষ্টি হয় নতুন আলোচনার। প্রতিবেদনটিতে পদ বাণিজ্যে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয় এ দুজনের বিরুদ্ধে।

এর আগে নাহিয়ান-লেখদের সাবেক কমিটি শোভন-রব্বানী মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পদ হারান চাঁদাবাজির অভিযোগে। সে সময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজের জন্য কমিশন চাওয়ার অভিযোগে তাদের পদচ্যুত করা হয়।

শিক্ষকদেরও ছাড়ে না ছাত্রলীগ

ছাত্র নির্যাতনের পাশাপাশি শিক্ষদের হেনস্তা করায় বারবার উঠে এসেছে ছাত্রলীগের নাম। বিশেষ করে ২০২১ সালের নভেম্বরে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যুর কারণ ছিল একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান ও তার অনুসারীদের করা মানসিক নির্যাতন।

সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাইনিং ম্যানেজার নির্বাচন নিয়ে চাপ প্রয়োগ, কতিপয় ছাত্রলীগ কর্মীদের জেরা, অপমান ও মানসিক নির্যাতনে স্ট্রোক করে মারা যান সেলিম হোসেন। পরবর্তীতে এ ঘটনায় খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ চার শিক্ষার্থীকে আজীবন বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

এ ছাড়া সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে ছাত্রলীগের অসদাচরণ থেকে শুরু করে, তৃণমূল পর্যায়ে ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘটনা ঘটছে হরহামেশা।

হেলমেট-হাতুড়ির নতুন ব্যবহার

ছাত্রলীগের বড় বড় শোডাউন গুলোতে দেখা যায়, মোটরসাইকেলে বসা নেতা থেকে কর্মী কারো মাথায় নেই হেলমেট। বাইক চালানোর সময় হেলমেট ব্যবহার না করলেও যেকোনো অরাজকতা ও মারামারিতে হেলমেট পরিহিত ছাত্রলীগ নেতারা আলোচনায় এসেছেন বারবারে।

২০১৮ সালে কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে যখন একাট্টা সারা দেশের শিক্ষার্থী, তখন মাথায় হেলমেট চাপিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপরে হামলা চালানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ। সেই থেকে শুরু; এরপর যখনই কোনো ঝামেলা হয়েছে মাথায় হেলমেট ও হাতে হাতুড়ি-হকিস্টিক নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েছেন ছাত্রলীগের কর্মীরা।

২০১৮ সালের এপ্রিলে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের দমাতে হেলমেটধারী সশস্ত্র ছাত্রলীগের মহড়া, একই বছর আগস্টে রাজধানীর জিগাতলা, ধানমন্ডি ও সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় আন্দোলনরত ছাত্র ও সাংবাদিকদের ওপরে হেলমেটধারী ছাত্রলীগের দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে হামলা ও সর্বশেষ নিউমার্কেটে হেলমেট পড়ে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগ নেতাদের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ানোর মতো ঘটনায় ছাত্রলীগের কাছে হেলমেটের ব্যবহার পেয়েছে এক নতুন রূপ।

ছাত্রলীগের খুনের শিকার বিশ্বজিৎ থেকে নাহিদ

ছাত্রলীগের নৈরাজ্য শুধু ক্যাম্পাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে ক্যাম্পাসের বাইরেও। ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকে হেনস্তার থেকে শুরু করে খুনের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে ছাত্রলীগ।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর দর্জি দোকানদার বিশ্বজিৎ দাসকে বাহাদুর শাহ পার্কের (ভিক্টোরিয়া পার্ক) সামনে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায় ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয়জনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত দুইজনকে খালাস দেন আপিল বিভাগ।

সে সময় বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড দেশে আলোড়ন তুলেছিল। মানুষ কতটা পাশবিক হতে পারে অবাক হয়ে দেখেছিল সাধারণ মানুষ। বারবার ঘৃণা ও নিন্দার মুখে পড়া ছাত্রলীগ তবুও থামায়নি তাদের পাশবিকতা।

সর্বশেষ ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে নিউমার্কেটে ব্যবসায়ী-ছাত্র সংঘর্ষে বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের মতো একই কায়দায় কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের কর্মীরা। পরবর্তীতে এ ব্যাপারে ঢাকা কলেজ কর্তৃপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কয়েকটি পদক্ষেপ নিলেও শেষমেশ বিশ্বজিৎ এর বিচারের রায় কার্যকরের মতো নাহিদের বিচার কতদিন ঝুলে থাকবে এ ব্যাপারে সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা।

দিনে ছাত্রলীগ রাতে ছিনতাইকারী

রাতের বেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার ও পলাশী এলাকা সাধারণ মানুষের জন্য এক আতঙ্কের নাম। এসব এলাকায় প্রায়ই ঘটছে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা।

সম্প্রতি শহীদ মিনার এলাকায় ছিনতাইয়ের কবলে পড়ে এক দম্পতি। ১০-১২ জনের একটি দল তাদের মারধর করে টাকা-পয়সা ও এটিএম কার্ড নিয়ে যায়।

পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তারা সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সদস্য। এদের মধ্যে ঢাবির ইতিহাস বিভাগের ফাহিম তাজওয়ার জয় ও আরেক জন তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের ছাত্র সাজিদ আহমেদের পরিচয় জানা গেছে। এ দুজনসহ বাকি অজ্ঞাতনামা ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

এর আগে চলতি মাসেই বুয়েট এলাকায় কাভার্ডভ্যান চালককে মারধর ও ১৫ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে ৩ ঢাবি শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশ। পরে জানা যায়, এরা সবাই ছাত্রলীগের সদস্য।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছাত্রলীগের এমন কয়েকটি গ্রুপ আছে যারা সুযোগ বুঝে বহিরাগতদের থেকে টাকা-মোবাইল থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ সব জিনিস ছিনতাই করে থাকে। অনেক সময় এসব গ্রুপের কাছে লাঞ্ছনার শিকার হয় খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।

এসবের পাশাপাশি গত বছর ডিসেম্বর নীলক্ষেতে সাধারণ মানুষের মোবাইল চেক করা, বিএনপির কোনো পোস্টে লাইক কিংবা সাবক্রিপশন থাকলে তাদের পিটিয়ে পুলিশে দেয়ার মতো সংবিধান বিরোধী ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো মারাত্মক সব অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে।

সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে ছাত্রলীগের বেহাল দশা ও বেপরোয়া আচারণ নিয়ে জানতে চাইলে প্রতিবারের মতো এবারও আশার বাণী শোনান তারা। তবে কবে শোধরাবে ছাত্রলীগ কিংবা আদৌ কী কোনো ইতিবাচক সংস্কার আসবে কি-না এমন কোনো কার্যকরী ইঙ্গিত দিতে পারেননি কেন্দ্রীয় নেতারা।

ছাত্রলীগ কেন বেপরোয়া জানতে চাইলে সংগঠনটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘যেকোনো মূল্যে যাতে শিক্ষা ও শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ ঠিক থাকে এ ব্যাপারে আমাদের নির্দেশনা দেয়া আছে। শিক্ষার্থীদের একটি সুন্দর ক্যাম্পাস লাইফ দেয়াই আমাদের মূল লক্ষ্য। র‍্যাগিংয়ের যে সংস্কৃতি আছে সেটা আমরা স্বীকার করছি। এটা বন্ধে এন্টি র‍্যাগিং মুভমেন্ট চালু করার চেষ্টা করছি। পারস্পরিক সম্মান ও সৌহার্দ্য বজায় রেখে শিক্ষার্থীরা যাতে ক্যাম্পাসে তাদের শিক্ষাজীবন চালিয়ে যেতে পারে তার জন্য ছাত্রলীগ চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

ছাত্রলীগের নাম ব্যবহার করে ক্ষমতার অপব্যবহার করা প্রসঙ্গে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘এ কথা সত্যি অনেকেই ছাত্রলীগের ছত্রছায়ায় ছদ্মবেশে নানা অপরাধ করে থাকে। তারা ব্যানার হিসেবে ছাত্রলীগকে ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে সাংগঠনিক অনুশীলন বজায় রেখে কমিটি দিতে পারলে ও সদস্য সংগ্রহের ব্যাপারটি কেন্দ্রীয় কমিটির নজরদারিতে রাখতে পারলে অনুপ্রবেশের ঘটনা শূন্যের কোটায় নেমে আসবে।’

বর্তমান কমিটি ছাত্রলীগে কোনো দৃশ্যমান সংস্কার আনছে কি-না জানতে চাইলে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান বলেন, ‘আমি মনে করি, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রতিটি কমিটি সফলভাবে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের সাংগঠনিক ধারা বজায় রাখার চেষ্টা করেছে। আমরাও সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করে যেতে চাই।’

স্থানীয় লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে নানা অপকর্ম করছে ছাত্রলীগ। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় কমিটির পদক্ষেপ সম্পর্কে ইনান বলেন, ‘কারও এলাকার রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকা দোষের কিছু না। কিন্তু সেই এলাকার ছাত্রলীগের কর্মীরা যাতে এলাকার রাজনৈতিক অপকর্মের সঙ্গে জড়িয়ে না যান সে ব্যাপারে ছাত্রলীগ সব সময় খেয়াল রাখে।’

ছাত্রলীগের এমন অধঃপতন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, স্বাধীনতার আগে ছাত্র সংগঠনগুলো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করতো না। এখন একেকটি স্থানীয় নেতাদের ডান হাতে পরিণত হয়েছে ছাত্রলীগ। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে দেখলে মনে হয় ছাত্রলীগ এ ধরনের অপকর্ম করতেই পারে। যদিও কেন্দ্রীয় নেতারা এটি স্বীকার করবেন না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ছাত্রলীগ যতদিন দলীয় লেজুড়বৃত্তির কাজ করবে ততদিন বড় কোনো ইতিবাচক সংস্কারের আশা করা যায় না।

Leave a Comment

error: Content is protected !!