আইনশৃঙ্খলায় পুলিশে গাছাড়া ভাব দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন

আইনশৃঙ্খলায় পুলিশে গাছাড়া ভাব দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন। পুলিশে পদায়নের জায়গা নিয়ে সংকট থাকলেও পদোন্নতির কমতি নেই। কিন্তু এত পদের ভিড়েও মাঠপর্যায়ে কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পাশাপাশি প্রশ্ন আছে পুলিশের অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভরতা নিয়ে।

মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষার বাইরে যেন অন্ধকারে তদন্তকারীরা। ফোনে কথোপকথন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কার্যক্রমকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে পুলিশ ও র‍্যাব। যদিও যেকোনো ঘটনার শুরুতেই ভুক্তভোগী ও অপরাধীদের ডিভাইসের দিকে নজর দেওয়া সময়ের প্রয়োজন বলেই অভিমত অনেক সাবেক কর্মকর্তা ও বিশ্লেষকের। তবে প্রচলিত তদন্ত, সোর্স রক্ষা করার অবস্থান থেকে সরে আসাও দুর্বল দিক বলে তাঁরা মনে করেন।

তবে ঢাকা মহানগর কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক নয়। আমরা সব ধরনের পদ্ধতিই ব্যবহার করছি। তা ছাড়া, পৃথিবী এখন প্রযুক্তিনির্ভর। সেখানে পুলিশ সেটা না করলে পিছিয়ে যাবে। প্রযুক্তি এখন অনেক কিছুরই সমাধান দিচ্ছে, অপরাধের ক্ষেত্রে সেটা হবে না কেন?’

১০ ডিসেম্বরের আগে রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কার্যালয়ে অনেকটা পুরোনো ধাঁচেই অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযান এবং পরবর্তী সময়ে বড় ভূমিকা পালন করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশিদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার এবং যুগ্ম কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান। অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ) এ কে এম হাফিজ আক্তারসহ সব কর্মকর্তাই ছিলেন মাঠে। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের মাঠে থেকে নির্দেশনা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁদেরই যদি সব করতে হয় তখন মাঠের কর্মকর্তাদের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। যদিও অতিরিক্ত কমিশনার হাফিজ আক্তারের দাবি, নয়াপল্টনে ডিসি, ওসিসহ জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা হামলায় গুরুতর আহত হওয়ায় পরিস্থিতি সামলাতে দ্রুত যোগ দেন অন্যরাও।

সর্বাধিক সময় ডিএমপি কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা আসাদুজ্জামান মিয়া বলেন, ‘মাঠের বিষয় মাঠের কর্মকর্তারাই মোকাবিলা করবেন। এখন যাঁরা তদারকিতে আছেন, তাঁরা কীভাবে চান—এটা বড় বিষয়।

কিন্তু যার কাজ তাকেই করতে দেওয়া উচিত। ওপরের কর্মকর্তারা দেখভাল করতে পারেন—মাঠে যিনি আছেন, তিনি ঠিকমতো কাজটা করছেন কি না।’

বেশ কয়েক বছর আগে ডিএমপির অপরাধ বিভাগ দ্বিগুণ করা হয়। ২০২০ সালে গোয়েন্দা ও ট্রাফিকেও আটটি বিভাগ করা হয়। প্রতিটির দায়িত্বে আছেন একজন উপকমিশনার (ডিসি); তাঁর অধীনে ন্যূনতম তিনজন অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এবং একেকটি জোনে সহকারী কমিশনার (এসি)। এলাকাভেদে পাঁচ-ছয়জন এসি আছেন প্রতিটি অপরাধ বিভাগে। এ ছাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি), বিট পুলিশ অফিসার, ফাঁড়ি ইনচার্জসহ নানা ভাগে ঢাকায় দায়িত্ব পালন করে পুলিশ।

বিএনপির কার্যালয়ে অভিযানসহ ১০ ডিসেম্বর পরিস্থিতি মোকাবিলায় ডিএমপির কোনো অপরাধ বিভাগের ডিসিকে তেমন কার্যকর ভূমিকায় দেখা যায়নি। পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিএমপির কমিশনারসহ ডিসি পদে অনেকেই নতুন। কেউ কেউ এমন পদে ঢাকায় প্রথম। তাই বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগছে। পুরোনো ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের ওপরেই ভরসা রাখতে হচ্ছে।

২০১৩-১৪ সালে মতিঝিল বিভাগের এডিসি থাকার সময় সরকারবিরোধী কর্মসূচি মোকাবিলায় শক্ত ভূমিকায় ছিলেন এস এম মেহেদী হাসান। মাঝে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর এখন তিনি ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ট্রাফিক)। এ ছাড়া একসময় তেজগাঁও বিভাগের ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হারুন অর রশিদ বর্তমানে ডিবিপ্রধান এবং বিপ্লব কুমার সরকার সদর দপ্তরে অপারেশনস বিভাগের যুগ্ম কমিশনার। তাঁরা মূলত তদারকি কর্মকর্তা। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যাঁদের মাঠে থাকার কথা সেই ডিসি, এডিসিদের ভূমিকা ম্রিয়মাণ।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘সংকট থাকলে তো মোকাবিলা করে দক্ষ হয়ে উঠবেন মাঠের এসি-ডিসিরা। তাঁরা না পারলে তাঁদের শেখাতে হবে। যদি সেই সুযোগে তদারকি কর্মকর্তারা মাঠে নেমে গেলে, একটা দূরত্ব তৈরি হবে। নির্দেশনা দেওয়া যাঁদের কাজ তাঁদের সেই কাজটাই করা উচিত। নতুনদের জানাশোনায় ফাঁক থাকলে তা শেখার জন্য আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।’

ডিভাইস ব্যবহার না করায় অধরা!

ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুত মেজর জিয়াউল হক জিয়াকে বহুদিন ধরেই খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ, র‍্যাব।

এ বিষয়ে সাবেক ডিএমপির কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা যে পদ্ধতি ব্যবহার করে অপরাধী গ্রেপ্তার করি, তা তিনি (জিয়া) জানেন। সে কারণে তিনি কোনো ডিভাইস ব্যবহার করেন না। প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার করে তাঁকে ধরা যাচ্ছে না।’

ঢাকার আদালতপাড়া থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনায়ও নাম আসে জিয়ার। তাঁর কোনো হদিসই নেই গোয়েন্দাদের কাছে। এ অবস্থায় জিয়া কোনো দিন ধরা পড়বেন কি না, সে প্রশ্ন অনেকের।

বুয়েট ছাত্র ফারদিন নূর পরশের মৃত্যু নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ ও র‍্যাব বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম তথ্য দেওয়ার পর এখন বলছে, ফারদিন সুলতানা কামাল সেতু থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তবে এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন ফারদিনের বাবা ও সহপাঠীরা।

এর আগে তদন্ত সংস্থাগুলো প্রযুক্তির সহায়তায় ফারদিনের যাতায়াত, মোবাইল ফোনের অবস্থান, বান্ধবীর সঙ্গে আলাপ নিয়ে নানা ধরনের বক্তব্য দেয়। কিন্তু প্রচলিত পদ্ধতি ব্যবহার না করে শুধু প্রযুক্তিনির্ভর হওয়ায় ফারদিনের আত্মহত্যার তথ্য গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না।

গত বছরের মে মাসে কলাবাগানের একটি বাসায় চিকিৎসক কাজী সাবেরা রহমানের মৃতদেহ পাওয়া যায়। পুলিশ জানায়, এই চিকিৎসককে হত্যা করা হয়েছে। তবে, থানা-পুলিশ থেকে ডিবি, তারপর পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্তে দেড় বছর পরও কোনো তথ্য নেই।

পুলিশের অনেক কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, অবস্থা এমন হয়েছে যে, কোনো অপরাধী যদি নিজের ফোন বন্ধ করে অপরাধ করে আর সেখানে যদি কোনো সিসি ক্যামেরা না থাকে, তাহলে পুলিশের পক্ষ তাকে খুঁজে বের করা একেবারেই সম্ভব নয়। এর কারণও বলেছেন তাঁরা। সেটা হলো, সোর্স রাখার সনাতনি পদ্ধতি থেকে সরে এসে প্রযুক্তির প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে ওঠা। এ কারণে যেখানে প্রযুক্তি নেই, সেখানে অন্ধকারে হাবুডুবু খাচ্ছে পুলিশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পুলিশ সদস্যদের কাজের প্রতি মনোযোগ কমে গেছে। তাঁরা তাকিয়ে আছেন রাজনৈতিক নেতৃত্বের দিকে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, এই প্রবণতা তত বাড়ছে। আবার অনেকে পেশাদারির বাইরে দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন—এমন অভিযোগও আছে।

উভয় পদ্ধতির সমন্বয়ের তাগিদ

এ বিষয়ে এ কে এক শহীদুল হক বলেন, প্রযুক্তির যুগে তদন্ত সংস্থার কাছে ডিজিটাল তদন্ত অগ্রাধিকার পাবে, এটা স্বাভাবিক। সহজে তথ্যগুলো পাওয়া যায়। তবে কৌশলগত সোর্স, তদন্ত কর্মকর্তার বিচক্ষণতাও গুরুত্বপূর্ণ। তদন্তে প্রযুক্তি ও প্রচলিত পদ্ধতির সমন্বয় ঘটানো জরুরি।

ফারদিনের ঘটনা প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সহযোগী অধ্যাপক ফারজানা রহমান বলেন, ‘প্রথমে দেখলাম লোকেশন, কথোপকথন ধরে নানা বক্তব্য। পরে জানানো হলো ছেলেটি আত্মহত্যা করেছে। আধুনিক যুগে প্রযুক্তি তদন্তের বড় অংশজুড়ে থাকে। কিন্তু ক্রাইম সিন (অপরাধস্থল) বাদ দিয়ে তদন্ত সম্ভব নয়। এ ছাড়া সোর্সের জন্য ভাতাও থাকে তদন্ত সংস্থাগুলোর। দুটোর মিলিত প্রচেষ্টায় সফল হওয়া সম্ভব। শুধু প্রযুক্তিনির্ভরতা মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে না। বড় ঘটনার ক্ষেত্রে মানুষের নজর থাকে সেটার তদন্ত যেন আস্থাপূর্ণ হয়।’

Leave a Comment

error: Content is protected !!