কতটা দুশ্চিন্তা সামনের দিনে? সৈয়দ নূর হোসেন

কতটা দুশ্চিন্তা সামনের দিনে? সৈয়দ নূর হোসেন। আমি এই মুহূর্তে বিদেশে বসে। দেশের সুস্থ মস্তিষ্ক অনেক মানুষের মতোই আমি খানিকটা ভীতসন্ত্রস্ত যে, দেশটা যাচ্ছে কোথায়। সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি জোট ক্রমান্বয়ে বড় বড় সমাবেশ করছে। তাদের হুংকার তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এককালে অর্থনীতির ছাত্র, মির্জা ফখরুল ইসলাম, বিএনপি জোটকে অসাধারণ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ছাত্র হিসেবে যা দেখেছি তাতে বোঝা যায়নি সেই মিষ্টিহাসি ভালো মানুষটি এমন অগ্নিবর্ষী নেতা হয়ে বিএনপির মতো বড় দলকে একলাই জাগিয়ে তুলবেন। তবে মির্জা ফখরুলের পার্লামেন্টে না যাওয়াটা বিরাট ভুল হয়েছে বলে আমি মনে করি।

কিন্তু সৌভাগ্যের বিষয় হলো, তার দল একজন সুন্দরী অগ্নিকন্যাকে সেখানে পাঠিয়েছে। তার মিষ্টি চেহারা এবং হাসি দেখলে মনে হয় না তার বক্তৃতায় কী রকম অগ্নিবর্ষণ তিনি করতে পারেন। তবে কথা হলো বিএনপি নেতৃবৃন্দ যেসব কথা ক্রমাগতভাবেই বলে যাচ্ছেন তা কি ঐতিহাসিকভাবে সত্যি? আমার কাছে মনে হয় তারা দীর্ঘদিন ধরে একটা অসত্য প্রচার করে আসছেন যে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের শুভ সূচনা হয়েছে।

কিন্তু তার হাত ধরে যে ‘গণতন্ত্র’ এসেছে তা যে বাংলাদেশকে ১৮০ ডিগ্রি ডিগবাজি খাইয়েছে! জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীসহ ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিয়ে রাজনীতিতে গঠনতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেশটিকে পাকিস্তানের ধাঁচে ইসলামিক রিপাবলিকের দোরগোড়ায় নিয়ে গেছেন। এটা তো সবাই অবহিত। নতুন করে বলা মানে কথার অপচয়।

আমরা কেন ভুলে যাই যে বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন তাতে ছিল যুদ্ধ-পরবর্তী ধ্বংস ও দারিদ্র্যের ছায়া। কিন্তু মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, মানুষের জন্য অসাধারণ দরদ এবং দূরদর্শিতা দিয়েও রাতারাতি কোনো জাদুকরি বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না। আমি তখন সবে চীনের সমাজতান্ত্রিক দেশ থেকে ফিরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছি।

কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়ন করেছি, তবে নেতা হওয়ার যোগ্যতা ছিল না। দেশে ফেরার পরে যে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বা দলগুলো সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় চালিত ছিল অর্থাত্ বামপন্থি, তাদের প্রতিই আমার সমর্থন ছিল এবং ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে মেজর জলিলের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে ভোট দিয়েছিলাম।

১৯৭০-৭১ সালে চীনে দেড় বছর থাকতে দেখেছি দারিদ্র্য প্রপীড়িত একটা বিশাল গরিব দেশ কীভাবে মাও সেতুঙের নেতৃত্বে নিজেদের আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। পশ্চিমা দেশের সমাজতন্ত্রবিরোধী লেখক এবং রাজনীতিবিদরা স্বভাবতই মাও সেতুংকে গালাগাল করেছে। কিন্তু এডগার স্নো এবং হ্যান সুইনের মতো বিশাল মাপের লেখকরা, যারা চীনের উত্থানকে ভেতর থেকে দেখেছেন তারা প্রশংসা করেছেন।

আমার মনে সন্দেহ নেই বঙ্গবন্ধু মানুষের কল্যাণের কথা চিন্তা করেই সবাইকে নিয়ে খানিকটা সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যদিও বঙ্গবন্ধু কোনোদিনই রাজনীতিক হিসেবে সমাজতন্ত্রের প্রবক্তা ছিলেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্যে দিয়ে বাকশাল বিলীন হলো। তবে যে গণতন্ত্র জিয়াউর রহমান উপহার দিয়ে গেলেন তার অভিশাপ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ শাসনেও আমরা মুক্ত হতে পারিনি। সেই জেনারেল এরশাদের সময় থেকে দেশে দুর্নীতি দিনে দিনেই বেড়ে চলেছে, দেশে এখন কোটি কোটি টাকার কোটিপতির ছড়াছড়ি।

বিএনপির মতো একটা বড় রাজনৈতিক দল অন্য বেশ কয়েকটা ছোট দলকে নিয়ে যেভাবে এগোচ্ছে তাতে ২০১৩-১৪ সালের ভীষণ সংঘাতময় দিনগুলোর ছায়া দেখতে পাচ্ছি। যেখানে-সেখানে বোমাবাজি এবং নিরীহ মানুষের জীবন সংহার দেখে মনে হচ্ছিল, এ বাংলাদেশ আমার নয়। তাই বিরোধী দলের নেতারা যখন হুংকার দিয়ে বলেন যে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন দিলে তার ফলাফল যা হবে তাতে আওয়ামী নেতারা দেশ ছেড়ে পালাবার সুযোগটিও পাবেন না! এর ব্যাখ্যা অনেকভাবেই করা যেতে পারে। তবে এর মানে যদি এই হয় যে, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদদের দেহে প্রাণ থাকবে না, তাহলে তো সেটা ভীষণ বিভীষিকার চিত্র। সে সম্ভাবনা থাকলে আওয়ামী লীগের মতো বড় দল কীভাবে সামাল দেবে সে চিন্তা যে তাদের ব্যাকুল করবে তা বলাই বাহুল্য।

আমাদের মাননীয় প্রধান মন্ত্রী, তথা শাসক দল আওয়ামী লীগের নির্বাচন নিয়ে দুশ্চিন্তার বিরাট কারণ। যুদ্ধংদেহি প্রধান রাজনৈতিক দলের একমাত্র দাবি, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা নির্বাচনের আগেই নিরপেক্ষ সরকারের হাতে দিতে হবে। তা নাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন হবেনা। যদি সুষ্ঠু নির্বাচন অতীতে আওয়ামী সরকার না করে থাকে, তার দায়িত্ব শুধু আওয়ামী লীগকে দিলে হবে না, বিরোধী দলগুলোরও। আমি আওয়ামী সরকারের আমলে সবগুলো নির্বাচনেই অতি সহজে ভোট দিয়েছি। আমি উত্তরায় রাজউক ইস্কুলে গিয়ে ভোট দিয়েছি। সেখানে আমার গৃহকর্মী এবং ড্রাইভারও পৃথকভাবে ভোট দিয়েছে। কেউই বুকে আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কা লাগিয়ে ভোট দিতে যায়নি।

প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল যে অগ্রিম জিঘাংসা নিয়ে কথা বলছে যে ক্ষমতা ছাড়লে আওয়ামী লীগের নেতারা পালাবার পথ পাবে না, তাতে কীভাবে নির্বাচনের আগে শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা নিরপেক্ষ সরকারের হাতে তুলে দেওয়ার সাহস পাবে! আর আমরা নিরপেক্ষ সরকার পাব কোথায়? এই সিস্টেমের বারোটা তো বিএনপি শাসন আমলেই বাজিয়ে দিয়েছে। তাই যে প্রথাটা মৃত, তাকে কবর থেকে টেনে তুলে আনলে কোনো লাভ হবে না। আবার নিরপেক্ষ সরকারের প্রধানকে নিয়ে বিতর্ক উঠবে। এখন সমাজ এমন এক জায়গায় আছে, তাতে কোথাও নিরপেক্ষতার চিহ্নমাত্র খুঁজে পাওয়া যাবে না—সেটা শিক্ষাঙ্গন বলেন, সুধী সমাজের কথা বলেন। খুব কম লোকই বিশ্বাস করে যে, নিরপেক্ষ বলতে দেশে কেউ আছে।

তবে কথা হচ্ছে, আন্দোলন ২০১৩ সালের মতো যদি দেশব্যাপী বিশৃঙ্খলা, বোমাবাজি এবং খুনাখুনির পর্যায়ে চলে যায়, তাহলে কী হবে। বিরোধী দলগুলোর বোঝা উচিত, আইনের দিক থেকে এবং গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের অবস্থানের যথেষ্ট যৌক্তিকতা আছে। আওয়ামী লীগের যেমন কোটি কোটি সমর্থক আছে, তেমনি সম্মিলিত বিরোধী দলগুলোর কোটি কোটি সমর্থক আছে। নির্বাচনের সময় তারা নাকে তেল দিয়ে ঘুমালে চলবে না। তারপর নির্বাচন হয়ে গেলে আবার কথা উঠবে দিনের ভোট রাতে হয়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী গত ১৩ বছরে দেশের জন্য চিন্তা করেছেন এবং বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটা গর্বের স্থানে নিয়ে গেছেন। তবে এটাও সত্যি, দুর্নীতি আকাশচুম্বী হয়েছে। অনেক দুষ্ট লোক হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে, ধনী গরিবের আয়ের বৈষম্য বহুগুণ বেড়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার স্বপ্নের কথা সব সময়েই বলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এ ধরনের সামাজিক বৈষম্য কোনোদিন কল্পনা করেননি। দেশে উন্নয়ন অনেক হয়েছে বলেই তিনি অনেক ভোট পাবেন, এটা মনে করা ঠিক হবে না। বিএনপির আমলে কী হয়েছে লোক তা ভুলে গেছে। তারেক জিয়া যে একুশের বোমা হামলায় জড়িত ছিলেন না এবং বিএনপি ক্ষমতায় এলে তিনিই যে প্রধানমন্ত্রী হবেন, সে কথা তারা বুক ফুলিয়েই বলছেন।

আমার শেষ কথা, আজকের তরুণ যেসব নেতা রাজনীতিতে এসেছেন তাদের আরো জোরদার ভূমিকা রাখতে হবে। শুধু একটা বড় দলের সঙ্গে স্লোগানে নামলে হবে না কিংবা শুধু আওয়ামী লীগ কি খারাপ কাজ করেছে বা করেনি—সে ঢোল পেটালে হবে না। তারা সবাই মিলে আওয়ামী লীগের বিপরীতে মুক্তিযুদ্ধের আশা ও স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে আলাদা করে জোট গঠন করতে পারেন, যা একদিন বড় রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হতে পারে।

বাংলাদেশে যে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি ছাড়া তৃতীয় কোনো বড় দলের উত্থান হবে না, সেটা মনে করা ঠিক না। পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে মুসলিম লীগের পতন ঘটিয়ে ভুট্টোর অভ্যুদয় ছিল অবিশ্বাস্য। এমনকি ইমরান খান যে সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন, সেটাই-বা কে ভেবেছে। পশ্চিমবঙ্গে একসময় কংগ্রেসকে হটিয়ে জ্যোতি বসুর বামপন্থি দল রাজ্য শাসন করেছে। এখনকার মমতা ব্যানার্জির কথাই ধরুন না কেন। এ ধরনের উদাহরণ ভূরি ভূরি পাওয়া যাবে।

লেখক :ফটোগ্রাফার এবং বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রদূত

Leave a Comment

error: Content is protected !!